সমস্ত লেখাগুলি

মনুর চোখে নারী – হিন্দু ধর্মে নারীর দুরবস্থা -
অজিত কেশকম্বলী
May 20, 2025 | মুক্তমনা | views:4 | likes:0 | share: 0 | comments:0

“বিশ্বের যা কিছু মহান, যা চিরকল্যানকর।

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।”

-কাজী নজরুল ইসলাম


এই মূল্যবোধ আধুনিক কবির থাকলেও ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রবক্তা মনুর কিঞ্চিতও ছিল না। ছিল না বলেই শূদ্রের পাশাপাশি, সকল বর্ণের নারীরই মানবিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করেছিলেন মনু। নারীর যে কোনও উঁচুজাতেই সম্মানজনক স্থান নেই, তাই তিনি স্পষ্ট করেছেন। তার রচিত শাস্ত্রের নাম ‘মানব শাস্ত্র’ অথবা ‘মনুসংহিতা’ এবং তার ধর্মের নাম ‘মানব ধর্ম’। বর্তমান মানবিক মূল্যবোধের সম্পূর্ণ বিপরীতে মনুর ‘মানব ধর্ম’ প্রকৃতপক্ষে ছিল  ‘দানব ধর্ম’, শোষণ-বঞ্চনার এক মারণাস্ত্র। মনুকে হিন্দু সমাজের আইন-কানুনের মূল প্রবক্তা বলা যায়।


এই মনুসংহিতাতে নারীকে জঘন্যভাবে উপস্থাপন করেছেন মনু, হরণ করেছেন তার সকল মৌলিক মানবিক অধিকার।

নারীদের সকল শিক্ষা,ধর্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন মনু-

উপনয়ন সংস্কারের মাধ্যমেই বৈদিক সমাজে পুরুষেরা তাদের শিক্ষাজীবনে প্রবেশ করতো কিন্তু মনু তার রচিত গ্রন্থে স্ত্রীদের উপনয়ন সংস্কার নিষিদ্ধ করেছেন এবং দেহশুদ্ধির জন্য তিন বর্ণের পুরুষদের যে সকল মন্ত্র উচ্চারণ করতে হত, স্ত্রীদের সে সকল মন্ত্র উচ্চারণে নিষেধ করেছেন। (২/৬৬) নারীদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেছেন।


নারীরা যে শিক্ষাহীন ছিল তা স্পষ্ট হয় মনুর নিচের উক্তিতে-

“যে ব্যক্তিকে অভিবাদন করা হবে সে ব্যক্তি যদি সংস্কৃত না জানেন তাহলে অভিবাদনের পর অভিবাদনীয় ব্যক্তিকে ‘আমি অভিবাদন করছি’-এই কথা বলবেন। স্ত্রীলোকদেরকে এইভাবেই অভিবাদন করবেন।” ২/১২৩

নারীরা পুরুষদের ন্যায় সংস্কৃত জানেন না, তাই প্রকাশ পাচ্ছে এই শ্লোকে।


ধর্মাচরণের স্বাধীনতাও যে মহিলাদের ছিল না তা পরিষ্কার হয় মনুসংহিতার নিচের শ্লোক থেকে-

“যেহেতু শাস্ত্রোক্ত বিধি অনুযায়ী মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমেই স্ত্রীজাতির জাতকর্ম সংস্কার পালিত হয় না তাই তাদের অন্তকরণ নির্মল হয় না। স্মৃতি শাস্ত্র ও বেদ প্রভৃতি ধর্ম শাস্ত্রের ওপর স্ত্রীজাতির কোনও অধিকার নেই। তাই তারা ধর্মজ্ঞ হতে পারে না। এমনকি কোনও মন্ত্রের ওপরেও স্ত্রীজাতির অধিকার না থাকায় তারা কোনও পাপ করলে মন্ত্রের সাহায্যে তা ক্ষালন করতে পারে না। তাই শাস্ত্রমতে স্ত্রিজাতি মিথ্যা অর্থাৎ অপদার্থ।” ৯/১৮


আরও বলা হয়েছে,

“স্ত্রীলোকের স্বামী ভিন্ন পৃথক যজ্ঞ নেই। স্বামীর অনুমতি ছাড়া কোনও ব্রত এবং উপবাস নেই। কেবলমাত্র স্বামীর সেবা করেই স্ত্রীলোক স্বর্গে যেতে পারেন।” ৫/১৫৫


শিক্ষাবঞ্চিত নারীদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে,

“বিবাহ সংস্কারই স্ত্রীলোকের বৈদিক উপনয়ন সংস্কার। সেখানে স্বামীর সেবাই হল গুরুকূলে বাস এবং স্বামীর গৃহ কর্মই হল প্রাতঃসন্ধ্যাকালীন হোমরূপ অগ্নি পরিচর্যা।”২/৬৭


নারীদের সম্বন্ধে করা হয়েছে জঘন্য সব মন্তব্য-

“ইহলোকে পুরুষদের দূষিত করা স্ত্রীলোকেদের স্বভাব। এই জন্য পন্ডিতেরা স্ত্রীলোকদের সম্পর্কে অসাবধান হন না।”২/২১৩

“স্ত্রীগণ সৌন্দর্য বিচার করেন না। যুবা কী বৃদ্ধ সে ব্যাপারেও তাদের কোনও আপত্তি থাকে না। সুরূপই হোক বা কুরূপই হোক পুরুষ পেলেই তারা তার সঙ্গে সম্ভোগ করেন।” ৯/১৪

“পুরুষের দর্শন মাত্রেই স্ত্রীজাতির মনে তার সঙ্গে মিলনের ইচ্ছা জন্মায়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই তাদের চিত্তচাঞ্চল্য থাকে।” ৯/১৫


“শয়ন, আসন, ভূষণ,কাম, ক্রোধ,পুরহিংসা, কুটিলতা ও কুৎসিত ব্যবহার- এইসকল প্রবৃত্তি স্ত্রীলোকের জন্যই সৃষ্টির সময় মনু কল্পনা করেছেন।অর্থাৎ ওইসকল প্রবৃত্তি নারীদের স্বভাবগত ব্যপার।” ৯/১৭


নারীর ‘অন্তকরণ নির্মল হয় না।’ ৯/১৮


শাস্ত্রমতে স্ত্রিজাতি মিথ্যা অর্থাৎ অপদার্থ। ৯/১৮


“মূর্খই হোক আর বিদ্বানই হোক কাম ক্রোধের বশীভূত পুরুষদের অনায়াসেই বিপথে নিয়ে যেতে কামিনীরা সমর্থ হয়।” ২/২১৪


ঋতুমতী নারীকে অশুচি বলে ঘোষণা করা হয়েছে, চণ্ডাল প্রভৃতি তথাকথিত  অশুচিদের সাথে ঋতুমতী স্ত্রীও অশুচির পর্যায়ে পড়েছে-

“চণ্ডাল, ঋতুমতী স্ত্রী, ব্রহ্মবধ করেছেন এমন পতিত ব্যক্তি, দশদিন পর্যন্ত নবপ্রসূতা সূতিকা,শব ও শবস্পর্শী- এদের স্পর্শ করলে স্নানের মাধ্যমেই শুদ্ধ হওয়া যায়।” ৫/৮৫


সুতরাং ভগবান মনুর কাছ থেকে আমরা কি শিখলাম? শিখলাম- চণ্ডাল, মরদেহ, খুনি, ঋতুমতী নারী, দশদিনের সন্তান প্রসবকারিনী সম অপবিত্রা।


ভ্রষ্ট পুরুষদের দোষ আড়াল করে মনু আউড়েছেন ভিন্ন বাণী, দোষ দিয়েছেন নারীর উপরেই-

“ইহ সংসারে দেহধর্মবশত সব মানুষই কাম ক্রোধের বশীভূত। তাই মূর্খই হোক আর বিদ্বানই হোক কাম ক্রোধের বশীভূত পুরুষদের অনায়াসেই বিপথে নিয়ে যেতে কামিনীরা সমর্থ হয়।” ২/২১৪


‘নারীদের এমন স্বভাবেই সৃজন করেছেন বিধাতা’, তাই নারীদের সব সময় বশে রাখার (রক্ষার) ব্যাপারে পুরুষদের সচেষ্ট হতে বলেছেন মনু (৯/১৬)-


মনু বলেছেন,

“বাল্যকালে স্ত্রীলোক পিতার বশে, যৌবনে স্বামীর বশে এবং স্বামীর মৃত্যু হলে পুত্রের বশে থাকবেন।পুত্র না থাকলে স্বামীর সপিণ্ডের বশে থাকবেন। অর্থাৎ স্ত্রীলোক কখনওই স্বাধীনভাবে অবস্থান করবেন না।” ৫/১৪৮


“শাস্ত্রমতে বিবাহের পূর্বে স্ত্রী জাতিকে কন্যা অবস্থায় পিতা রক্ষা করবেন।যৌবন অবস্থায় বিবাহিত স্ত্রীকে স্বামী রক্ষা করবেন। বৃদ্ধ কালে পুত্র রক্ষা করবেন। এমনকি পতিপুত্রহীন নারীকেও নিকটস্থ পিতৃ প্রভৃতিরা রক্ষা করবেন, কোনও অবস্থাতেই স্ত্রী জাতি স্বাধীন থাকবেন না।” ৯/৩


“স্বামী প্রভৃতি আত্মীয় পরিজনেরা দিনরাত্রির মধ্যে কখনওই স্ত্রীজাতিকে স্বাধীনভাবে অবস্থান করতে দেবেন না। বরং সর্বদাই নিষিদ্ধ রূপ ও রসের ব্যাপারে তাদের অনাসক্ত করে তাদেরকে নিজের বশে রাখবেন।”৯/২


“কী বালিকা, কী যুবতী, কী বৃদ্ধা গৃহে থাকাকালীন কোনও কাজই স্বতন্ত্রভাবে করতে পারবেন না।” ৫/১৪৭


“স্ত্রীলোক কখনওই পিতা,স্বামী বা পুত্রের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার চেষ্টা করবেন না। কারণ এদের থেকে পৃথক হলে পিতৃকূল ও পতিকূল- উভয় কূলকেই তিনি কলঙ্কিত করবেন।” ৫/১৪৯


নারীদের বশে রাখার বিভিন্ন উপায় বর্ণনা করেছেন মনু-

“কোনও পুরুষই বল প্রয়োগ করে কোনও স্ত্রীকে সৎ পথে রক্ষা করতে পারে না। তবে নিম্নোক্ত উপায় অবলম্বন করলে স্ত্রীদের সহজেই রক্ষা করা যায়।” ৯/১০


উপায়গুলো হল-

“অর্থের সংগ্রহ ব্যয় সাধনে, নিজের শরীর ও গৃহ দ্রব্যের শুদ্ধিবিধানে, স্বামীর স্থাপিত অগ্নির শুশ্রুসায়, পাককার্যে এবং বিভিন্ন গৃহ দ্রব্যের পর্যবেক্ষণে স্ত্রী জাতিকে সর্বদা নিযুক্ত রাখা উচিত। এই সকল বিষয়ের কার্যভার স্ত্রীর উপর অর্পণ করলে সর্বদাই সৎ কর্মে ব্যস্ততায় মগ্ন থাকায় কুকর্ম ঘটানোর সম্ভাবনা থাকে না।” ৯/১১


নারীদের বশে রেখে শাসন করার জন্য ভগবান মনু বানিয়েছেন সকল বৈষম্যমূলক আইন; এমনকি নারীদের প্রহার করতেও বলা হয়েছে তার রচিত মানবশাস্ত্রে-

“পত্নীর সঙ্গে কখনওই তিনি (স্নাতক ব্রাহ্মণ) একপাত্রে ভোজন করবেন না।” ৪/৪৩

“স্ত্রী,পুত্র,দাস,শিষ্য এবং সহোদর কনিষ্ট ভাই অপরাধ করলে সূক্ষ্ম রজ্জু দিয়ে অথবা বেণুদল বা বাঁশের বাখারি দিয়ে শাসনের জন্য তাদের আঘাত করবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে রজ্জু বা বাখারি দিয়ে শরীরের পৃষ্ঠ দেশেই একমাত্র আঘাত করতে হবে কখনওই উত্তমাঙ্গে বা মস্তকে আঘাত করা যাবে না।” ৮/২৯৮-৩০০

স্বামী অপরাধ করলে স্ত্রী কি করবে, এ বিষয়ে যে কিছু বলা নেই, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।


নারীকে সম্পদ থেকে বঞ্চিত করে বলা হয়েছে- 

“বন্ধ্যা নারী অর্থাৎ যার স্বামী অন্য স্ত্রী গ্রহণ করে গ্রাসাচ্ছাদন বহনোপযোগী অর্থ দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছে,পুত্রহীন প্রোষিতভর্তৃকা, যে স্ত্রীর কোনও সপিণ্ড অভিভাবক নেই অথচ যে নিজে সাধ্বী, বিধবা এবং রুগ্না স্ত্রী – এদের সকলের ধন অনাথ বালকের সম্পদের মতোই রাজা নিজে রক্ষা করবেন।” ৮/২৮


নারীর বাল্যবিবাহ ও বিবাহে বয়সবৈষম্য

“তিরিশ বছরের যুবক মনোমতো বারো বছরের কন্যাকে বিবাহ করবে। চব্বিশ বছরের যুবক মনোমতো আট বছরের কন্যাকে বিবাহ করবে। কিন্তু যদি ধর্মহানির আশঙ্কা থাকে অর্থাৎ ব্রহ্মচারীর বেদ গ্রহণ যদি তিরিশ বা চব্বিশ বছরের আগেই শেষ হয় তাহলে আগেই বিবাহ করা যেতে পারে। টীকাকার কুল্লুকের মতে, কন্যার বয়স অপেক্ষা বরের বয়স প্রায় তিন গুণ বেশি হবে- এই মাত্রা জ্ঞাপন করাই এই বচনের তাৎপর্য। কন্যার বয়ঃক্রম নির্ধারণ করা এই বচনের তাৎপর্য নয়।” (৯/৯৪)

এইভাবে একদিকে নারীদের বাল্যবিবাহের বিধান দেওয়া হয়েছে এবং অপরদিকে শিশু কন্যার সাথে তার তিনগুণ বয়সের পুরুষের বিবাহের নিয়ম তৈরি করা হয়েছে।

নিচুজাতির কন্যাকে ভোগ করার প্রবৃত্তি এবং উচ্চবর্ণের কন্যার সাথে নিম্নবর্ণের পুরুষের বিবাহের অস্বীকৃতি। 

আর্যদের বর্ণপ্রথা সম্বন্ধে আপনারা সকলেই হয়তো কমবেশি জানেন। এই প্রথায় ব্রাহ্মণ সবচেয়ে সুবিধাভোগী, শূদ্র সবচেয়ে নির্যাতিত আর অস্পৃশ্যদের তো মানুষ হিসাবে স্বীকৃতিই নেই। এই বর্ণপ্রথায় নারীভোগের এক বিশেষ পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল সুচতুর ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়। ব্রাহ্মণ এর ঘাড়ে দোষ চাপানোর কারণ হল, এইসব রীতি নীতির তারাই প্রবক্তা এবং তারাই এর সবচেয়ে নির্লজ্জ সুবিধাভোগী। বর্ণপ্রথাতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র সবার মধ্যে শিক্ষা, জীবিকা, ধর্মাচার সকল বিষয়ে অসাম্য ও বৈষম্য  কাজ করতো এবং সেই বৈষম্যের কুৎসিত প্রকাশ পায় নারী বিবাহ/ ভোগ বিষয়ে।


বিবাহের ক্ষেত্রে বর ও কনের বর্ণ বিবেচনা করে বিবাহকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল।

১/ অনুলোম বিবাহঃ উচ্চ বর্ণের পুরুষের সাথে নিম্নবর্ণের স্ত্রীর বিবাহ।

২/ প্রতিলোম বিবাহঃ এক্ষেত্রে কন্যা উচ্চবর্ণের ও বর নিম্নবর্ণের হয়ে থাকে।

ব্রাহ্মণ মনু তার শাস্ত্রে অনুলোম বিবাহের অনুমোদন দেন এবং প্রতিলোম বিবাহকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন।

এই অনুলোম-প্রতিলোম নিয়মের ফলে ব্রাহ্মণ চাইলে ব্রাহ্মণী,ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা ও শূদ্রা যেকোনও বর্ণের স্ত্রীকে বিবাহ করতে পারতো।

ক্ষত্রিয় পারতো ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা, শূদ্রা রমণীকে বিবাহ করতে। কিন্তু ক্ষত্রিয়ের ব্রাহ্মণীকে বিবাহ করা নিন্দনীয় ছিল।

বৈশ্য, বৈশ্যা ও শূদ্রা নারীকে বিবাহ করতে পারতো কিন্তু ক্ষত্রিয়া ও ব্রাহ্মণীকে বিবাহ করতে পারতো না।

কিন্তু শূদ্র বেচারা সবার নিচে অবস্থান করায় সে কেবল শূদ্রাকেই বিয়ে করতে পারতো তার অন্য বর্ণে বিবাহের কোনও অধিকার ছিল না।


এই পদ্ধতির বিশ্লেষণে দেখা যায় কূট বুদ্ধিসম্পন্ন ব্রাহ্মণ সকল বর্ণের নারীর উপর তার হস্ত চালনা করেছে।বাকি বর্ণ গুলোও পারছে অন্যান্যা বর্ণের নারীকে বিবাহ করতে কিন্তু শূদ্র জাতি (বিশেষত শূদ্র পুরুষ) বঞ্চিত হচ্ছে অন্য বর্ণে বিবাহে এবং শূদ্রা পরিণত হয়েছে সকল উচ্চবর্ণের সাধারণ ভোগ্যপণ্যে।


অপরদিকে, আর্যরা তাদের নারীদের ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করেছে। যখন উচ্চবর্ণের কোনও নারী নিম্নবর্ণের কোনও পুরুষকে বিবাহ করতে গিয়েছে তখনই উৎপন্ন সন্তানকে নিন্দনীয় বর্ণসংকর ঘোষণা করা হয়েছে এবং তাদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান করা হয়েছে।


মনু বলেন,

“নিকৃষ্ট জাতির কন্যা যদি সম্ভোগের জন্য নিজের থেকে উৎকৃষ্ট জাতির পুরুষকে ভজনা করে তাহলে ঐ কন্যার কিছুই দণ্ড হবে না।কিন্তু সে যদি অপকৃষ্ট জাতির পুরুষকে ভজনা করে তাহলে যে পর্যন্ত তার কাম নিবৃত্তি না হয় সে পর্যন্ত তাকে গৃহে আটকে রাখতে হবে।”৮/৩৬৫

“উত্তম জাতির সকামা কন্যাকে অধম জাতির পুরুষ যদি ভজনা করে তাহলে ঐ পুরুষের শারীরিক বধ দণ্ড হবে। …” ৮/৩৬৬

মহর্ষি মনু ‘কোনও অভিযোগ না করে উচ্চ তিন বর্ণের দাসত্ব (সেবা) করে যাওয়াকে’ – শূদ্রের কর্তব্য বলে বর্ণনা করেছিলেন কিন্তু তার সমাজে নারী যেন অলিখিত শূদ্র। কোনও বর্ণেই তার যেন মর্যাদা নেই, স্বাধীনতা নেই। শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নারীকে পিতা-ভ্রাতা-স্বামী-রাজার দাস করে রেখেছিলেন মনু ও তার সমাজ। তাই তো দাসরূপ নারীকে বলা হয়েছে,


পতিসেবাই তার একমাত্র ধর্ম-

“পিতা স্বয়ং যে ব্যক্তির কাছে কন্যা দান করেছেন কিংবা পিতার অনুমতিক্রমে ভাই যে ব্যক্তির কাছে বোনকে দান করেছেন, সেই স্বামীর জীবিতকাল পর্যন্ত তার সেবা করা এবং স্বামীর মৃত্যুর পরও ব্যভিচার না করা স্ত্রীলোকের কর্তব্য।” ৫/১৫১

স্ত্রীলোককে গৃহ কর্মে দক্ষ হতে বলা হয়েছে। (৫/১৫০)


কায়মনোবাক্যে পতিসেবা পরায়ণতাই স্ত্রীজাতির ধর্ম। পতিসেবাপরায়ণ ভক্তিমতী স্ত্রীদের পুরষ্কার স্বরূপ স্বামী-পিতামহের পিণ্ডের উচ্ছিষ্ট দান করার কথা বলা হয়েছে। (৩/২৬২) কায়মনোবাক্যে পতিসেবাপরায়ণ নারীধর্ম পালনকারী নারী ইহলোকে অত্যন্ত সুখ্যাতি পান এবং মৃত্যুর পরে পতিলোকে গমন করেন। (৫/১৬৬-১৬৭) তাই স্বামীর জীবনকালে, এমনকি মৃত্যুর পরেও স্ত্রীদের অনিষ্টাচরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। স্বামীর মৃত্যুর পরেও কখনওই তার মৃত স্বামীর অপ্রিয় আচরণ না করতে বলা হয়েছে। এর ফলেই নাকি স্ত্রী তার উপার্জিত পূণ্যে স্বামীর কাছে স্বর্গে গমন করবেন (৫/১৫৬) এবং ইহলোকে সাধ্বী স্ত্রীর খেতাব প্রাপ্ত হবেন! (৯/২৯)

স্বামী ধন,মান,কূল,শীলে অপকৃষ্ট হলে স্ত্রীলোকের অন্যকোনও পুরুষকে গ্রহণ করাকে নিন্দনীয় বলা হয়েছে। (৫/১৬৩)

‘আমি ধনীর কন্যা’- এরূপ দম্ভরূপে অথবা নিজের সৌন্দর্যের অহংকারে কোনও নারী স্বামীকে ত্যাগ করে অন্য পুরুষকে গ্রহণ করলে তাকে লোকজনের সামনে কুকুর দিয়ে খাওয়ানোর কথা বলা হয়েছে। আর সেই নারী যে পুরুষের সঙ্গ লাভ করেছিল তাকে গরম লৌহ শয্যায় শুইয়ে রেখে পুড়িয়ে মেরে ফেলার কথা বলা হয়েছে এবং যতক্ষণ না সেই পুরুষ পুড়ে ছাই হয়ে যায় ততক্ষণ আগুনে কাঠ নিক্ষেপ করতে বলা হয়েছে। (৮/৩৭১-৩৭২)

স্ত্রীর দাসত্ব স্বামীর মরণেও শেষ হয় না, তাকে মৃত স্বামীরও দাসত্ব করতে হয়।


স্বামী মারা গেলে স্ত্রীজাতির কর্তব্য-

স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীদের পুনর্বিবাহ অর্থাৎ বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ করে বলা হয়েছে- 

“…বিবাহ সম্বন্ধীয় শাস্ত্রে এমন কোনও বিধি লিখিত নাই যে বিধবাদের পুনর্বিবাহ হতে পারে।” ৯/৬৫


বিধবার জীবন ছিল মৃত্যুর থেকেও ভয়ঙ্কর, বিধবার যাতে আর দৈহিক সৌন্দর্য না থাকে, সে যাতে আর অন্য পুরুষকে আকৃষ্ট করতে না পারে তাই কঠোর ব্রহ্মচর্যের মাধ্যমে তার সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয়ার জন্য বলা হয়-

“স্বামী মারা গেলে স্ত্রী পবিত্র ফলমূল আহার করে জীবন যাপন করবেন। কিন্তু কখনওই ব্যভিচারের ইচ্ছায় পরপুরুষের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করবেন না।” ৫/১৫৭


“যতদিন না নিজের মৃত্যু হয় ততদিন পর্যন্ত পতিপরায়ণা স্ত্রী ক্লেশ সহিষ্ণু ও নিয়মচারিণী হয়ে মধু মাংস ও মৈথুন বর্জন করে ব্রহ্মচর্য পালন করবেন। অর্থাৎ সতী সাধ্বী স্ত্রীলোকের যা অন্যতম পরম ধর্ম সেই ধর্ম পালনেই তিনি একাগ্র হবেন।” ৫/১৫৮

“ সদাচারশালী স্ত্রী স্বামীর মৃত্যু হলে ব্রহ্মচর্য ব্রত অবলম্বন করবেন। কিন্তু কখনওই পরপুরুষের সংযোগে পুত্র উৎপাদন করবেন না। কারণ অপুত্রা হলেও উক্ত ব্রহ্মচারীদের (বালখিল্য ঋষি) মতোই তিনিও স্বর্গে গমন করতে পারবেন।”৫/১৬০


স্ত্রী যাতে পরপুরুষের সাথে কোনোরূপ সম্পর্ক না করতে পারে সেদিকে আর্যরা বেশ সচেষ্ট ছিল। (৯/৮-৯)বিধবা রমণীকে ভয় দেখিয়ে বলা হয়েছে, 

“স্ত্রীলোক যদি পরপুরুষের উপভুক্ত হন তাহলে ব্যভিচার দোষে সংসারে নিন্দনীয় হন। এইরূপ স্ত্রীলোক পরকালে শেয়াল হয়ে জন্মান এবং কুষ্ঠ প্রভৃতি বিভিন্ন পাপরোগে আক্রান্ত হয়ে অত্যন্ত পীড়া ভোগ করেন।” (৫/১৬৪ ; ৯/৩০)


সুতরাং স্ত্রীজাতির দায়িত্ব আমরণ তার স্বামীর সেবা করা এবং স্বামীর মারা গেলেও তার অপ্রিয় আচরণ অর্থাৎ অন্য পুরুষের সংসর্গ না করা  এবং পুনরায় বিবাহ থেকে বিরত থাকা এবং কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করা।



এবার তাদের স্ত্রীদের আজীবন কষ্টের কি প্রতিদান দিয়েছেন আর্যপুরুষেরা দেখা যাক-

নারীদের সাথে প্রতারণার ভালোই পথ তারা বেছে নিয়েছিল আর্য পুরুষেরা। মনু তাদের সেইরকমই শিক্ষা দিয়ে বলেন,

“‘তুমি আমার পরম প্রেয়সী,অন্যকে আমি প্রার্থনা করিনি’- এইভাবে সঙ্গ লাভের জন্য কামিনী (নারী) বিষয়ে মিথ্যা শপথ করলে পাপ হয় না। ‘আমি অন্য বিবাহ করবো না’, এইরূপ ক্ষেত্রে বিবাহ বিষয়ে এবং গোরুর ভক্ষ্য বিষয় সম্বন্ধে,হোমের জন্য কাষ্ঠ আহরণ বিষয়ে এবং ব্রাহ্মণের রক্ষার জন্য মিথ্যা শপথে কোনও পাপ হয় না।” ৮/১১২


বিবাহিতা নারীর প্রতি শক্ত হয়েছে আর্যসমাজ, নারীর ত্রুটি পেলেই তাকে ত্যাগ করতে বলা হয়েছে। মনুর শাস্ত্রে বলা হয়েছে-

মদ্যপানে আসক্ত, দুশ্চরিত্র, পতিবিদ্বেষিণী, কঠিন রোগগ্রস্থ, অপকার সাধনে সক্ষম, ধনক্ষয়কারী স্ত্রীকে ত্যাগ করে স্বামীকে দ্বিতীয় বিবাহ করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। (৯/৭৯-৮০)

“…স্ত্রী যদি অপ্রিয়ভাষিণী হন তাহলে কালক্ষয় না করে তৎক্ষণাৎ স্বামী বিবাহ করবে।” ৯/৮১

“স্ত্রী যদি স্বামীর প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন হন তাহলে স্বামী স্ত্রীর জন্য এক বৎসর কাল প্রতীক্ষা করবে। তার মধ্যে স্ত্রীর দ্বেষভাব গত না হলে স্বামী তাকে অলঙ্কার প্রভৃতি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে তার সহবাস ত্যাগ করবে।” ৯/৭৭


ঘরে স্ত্রী থাকার পরেও স্বামী যদি পুনরায় বিবাহ করেন, আর তাতে স্ত্রী যদি নারাজ হয়ে ঘর ছেড়ে চলে যেতে উদ্যত হন তাহলে সেই স্ত্রীকে অবরুদ্ধ করার উপদেশ দেয়া হয়েছে মনুস্মৃতিতে অথবা সেই স্ত্রীকে আত্মীয় স্বজনের সামনে ত্যাগ করার কথা বলা হয়েছে। (৯/৮৩)

এবং সর্বোপরি সতী সাধ্বী স্ত্রী মারা যাওয়ার পর স্বামীকে পুনরায় বিবাহ করতে বলা হয়েছে-


“সতী সাধ্বী স্ত্রী আগে মারা গেলে তার দাহকার্য ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাপ্ত করার পর পুরুষ পুনরায় বিবাহ করবেন এবং পুনরায় অগ্ন্যাধান কর্ম সম্পন্ন করবেন। এইভাবে পূর্বোক্ত বিধান অনুযায়ী নিত্য পঞ্চমহাযজ্ঞ সম্পাদন করবেন এবং পুনরায় দার পরিগ্রহ করে পরমায়ুর দ্বিতীয় ভাগে গৃহস্থাশ্রমেই বাস করবেন। “৫/১৬৮-১৬৯


পুত্রপ্রাপ্তিতে মরিয়া মনুর সমাজ-

পুত্রের জন্য মানুষ স্বর্গ লাভ করে। পৌত্রের জন্য মানুষ ঐ স্বর্গ লোকে চিরস্থায়িত্ব লাভ করে এবং প্রপৌত্রের জন্য মানুষ সূর্যলোক লাভ করে। মনুসংহিতা ৯/১৩৭


পুত্র শুধু স্বর্গে পৌঁছাতে সাহায্য করে না, স্বর্গের সাথে সাথে পুত্র নরক থেকেও তার পিতৃকুল ও মাতৃকুলকে ও রক্ষা করে-


“পুত্র যেহেতু পিতাকে পুৎ নামক নরক থেকে ত্রাণ করে তাই ব্রহ্মা স্বয়ং ‘পুত্র’ এই নাম রেখেছেন। পৌত্র এবং দৌহিত্রের মধ্যে এমন কিছু পার্থক্য শাস্ত্রে বলা হয়নি। কারণ দৌহিত্র পরলোকে পৌত্রের মতোই মাতামহকে পরিত্রাণ করে।…” ৯/১৩৮-১৩৯


সনাতন নারী শস্যক্ষেত্র, পুরুষ সেই ক্ষেত্রের মালিক-

পুত্র যেহেতু স্বর্গের দ্বার ও নরক হতে উত্তরণের পথ তাই আর্যরা পুত্রলাভের জন্য অত্যন্ত মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কখনও কখনও দেখা গেল, কোনও কোনও আর্যপুরুষ ললাটদোষে উর্বরতাহীনতার কারণে পুত্র উৎপাদনে অক্ষম। কেউ কেউ অপুত্রক অবস্থায় ভুত-প্রেতে পরিণত হল। এমন জটিল পরিস্থিতিতে ভগবান মনুই তাদের পথ দেখালেন, বাতলে দিলেন পুত্রপ্রাপ্তির পথ। যেহেতু বেদে বলা আছে বিধাতা নারীকে গর্ভ ধারণের জন্যই সৃষ্টি করেছেন (৯/৯৬) তাই, স্থির হল, চুপিসারে গভীর রাতে নপুংসক স্বামী অথবা গুরুজনের আদেশে সধবা অথবা বিধবা স্ত্রীকে ঘি মাখিয়ে প্রস্তুত করে রাখা হবে, আর ওই রমণীর সাথে কোনও পরিচিত পরপুরুষ রমণ করবে এবং তার গর্ভে একটি পুত্র উৎপাদন করবেন।কখনও একাধিক পুত্র উৎপাদনের বিধানও দিয়েছিলেন মহর্ষি মনু। (৯/৬০, ৯/৬১) এই গোপন কর্মে পরপুরুষ যত কাছের হবে, ব্যাপারটিও ততোই গোপন রবে। তাই আর্যধর্ম অনুযায়ী দেবর আর ভাসুরের কর্তব্য স্থির হল- গভীর রাতে ভ্রাতৃবধুরমণ। (৯/১৪৬) তবে, দেবর- ভাসুরের অভাবে বংশের অন্য কোনও পুরুষকেই এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে হত। যেভাবেই হোক নরক থেকে নিষ্কৃতি ও স্বর্গ মার্গে পদক্ষেপন করতে তো হবে!


পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। এই যে গুপ্ত পদ্ধতিতে পুত্র উৎপন্ন হল, এই পুত্র তো স্বর্গগমনেচ্ছুক আর্যপুত্রের ঔরসজাত নয়। তাহলে কি করে সে মৃত্যু-পরে স্বর্গোপরে লীলা-খেলা করবে?


এই প্রশ্ন ও বিস্ময়ের সমাধান দিয়েছেন, আমাদের মনু ভগবান। তিনি দাঁড় করিয়েছেন তার ‘ক্ষেত্রজপুত্র’ নামক থিওরি। এই তত্ত্বে তিনি নারীকে, এবার পরিণত করেছেন ক্ষেতে। মনু বলেছেন, নারী হল পুরুষের ক্ষেত আর পুরুষ এর থাকে বীজ। (৯/৩৩-৩৪) আর খেতে বীজ লাগিয়েই চারাগাছ উৎপন্ন করা হয়। কিন্তু রাম এর ক্ষেতে যদি বলরাম অমাবস্যার রাতে, অন্ধকারে,বীজ লাগিয়ে আসে, আর তাতে ধান, গম এর ফলন হয়, তবে রাম তার ক্ষেতের ফসল বলরামকে দেবে কেন, যতই বলরামের বীজ হোক না কেন?


ভগবান মনুর ভাষায়,

“যেমন অন্যের গাভী,মহিষী,স্ত্রী উট ও স্ত্রী ঘোড়া প্রভৃতি জন্তুদের সঙ্গে অন্যের বৃষ, মহিষ,উট এবং ঘোড়া প্রভৃতির মিলনে উৎপন্ন সন্তান গাভী প্রভৃতি পশু মালিকদেরই অধিকৃত হয়ে থাকে; বৃষ প্রভৃতি পশু মালিকদের হয় না। সেইরূপ পরক্ষেত্রে অর্থাৎ পরস্ত্রীতে উৎপাদিত সন্তান উৎপাদকের হয় না, ক্ষেত্র স্বামীরই হয়ে থাকে। যার ক্ষেত্র নেই কেবল বীজ আছে সে যদি পরের ক্ষেত্রে বীজ বপন করে তাহলে তার শস্যফল কিছুই লাভ হয় না। ক্ষেত্রস্বামীই ঐ ফল ভোগ করে থাকে।”

(৯/৪৮-৪৯)


এইভাবেই নারীকে ক্ষেতে রূপান্তরিত করে তাতে নানান জাতের বীজ লাগাতেন প্রতিভাবান আর্যপুত্রগণ।

ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবসময় নারীর ইচ্ছার  মূল্য দেওয়া হত না, স্বামীর মৃত্যুর পর নারী যাতে স্বেচ্ছায় ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনের মাধ্যমে পরপুরুষের সাথে মিলিত হতে না পারে এবং নারীর তথাকথিত  সনাতন সতীত্ব যেন কোনোমতে ক্ষুণ্ণ না হয় সেজন্য নারীকে এই কাজ করতে নিরুৎসাহিত করে মনু ভগবান চরম স্ববিরোধী কথা বলেন-

(উল্লেখ্যঃ- বিধবা নারীর পুনর্বিবাহও নিষিদ্ধ করেছিলেন মনু, কিন্তু স্ত্রী মারা যাওয়ার সাথে সাথেই পুরুষকে পুনরায় বিবাহ করতে বলেছিলেন।)


“সন্তান না থাকলে স্বর্গ গমন হয় না একথা ভুল। বালখিল্য প্রভৃতি বহু সহস্র ব্রহ্মচারী ব্রাহ্মণ সন্তান উৎপাদন না করেই কেবলমাত্র ব্রহ্মচর্য বলেই অক্ষয় স্বর্গ লোক লাভ করেছেন। সুতরাং ওই সকল ব্রহ্মচারীর মতোই সাধ্বী স্ত্রী সন্তানবতী না হলেও স্বীয় ব্রহ্মচর্য বলেই স্বর্গ গমন করেন।”  ৫/১৫৯


ক্ষেত্রজ পুত্রের উদাহরণ হিসাবে বলা যায় মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্র, পান্ডু প্রভৃতির জন্মকথা। মহাভারতের রাজা বিচিত্রবীর্য অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে, বংশের গুরুজনেরা তার স্ত্রী অম্বিকা এবং অম্বালিকার গর্ভে ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনের পদক্ষেপ নেন। মাতা সত্যবতী স্থির করেন তার পুত্র বেদব্যাস দ্বারা মৃত পুত্রের স্ত্রী অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে পুত্র উৎপাদন করবেন। ডাকা হল বেদব্যাসকে। গভীর রাতে তিনি বৌদিদের শয়নকক্ষে প্রবেশ করলেন। যেহেতু বেদব্যাস অত্যন্ত কুৎসিত, কদাকার দেখতে ছিলেন তাই অম্বিকা ও অম্বালিকা সম্মত ছিলেন না বেদব্যাসের সাথে পুত্র উৎপাদনে।


সঙ্গমকালে অম্বিকা চোখবুজে কুরু বংশের অবিবাহিত বীর ভীষ্মের কথা ভাবছিলেন, আর অপরদিকে অম্বালিকা ভয়ে পাণ্ডু বর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন। সহবাসকালে অম্বিকার চোখ বন্ধ থাকার কারণে কারণে তার পুত্র ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হলেন, আর ভয়ে অম্বালিকার গায়ের রঙ পান্ডু বর্ণ হয়ে যাওয়ার ফলে তার পুত্রের নাম হল পান্ডু।

অর্থাৎ দেখা যায়, বেদব্যাস ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনের জন্য অম্বিকা ও অম্বালিকাকে একপ্রকার ধর্ষণ করেছিলেন।


কতই না মহৎ ছিলেন আর্যপুরুষগণ। প্রয়োজনে স্ত্রীকে ক্ষেত বানিয়েছেন।সেই ক্ষেতে নানা জাতের বীজ লাগিয়েছেন।সেই ক্ষেত থেকে অদ্ভুত রকম ফলন পেয়েছেন এবং প্রয়োজনে স্ত্রীদের ধর্ষণও করিয়েছেন!


সহায়ক গ্রন্থ-


মনুসংহিতার অধিকাংশ শ্লোকের তর্জমা চৈতালি দত্তের অনুবাদকৃত মনুসংহিতা হতে গৃহীত হয়েছে


মনু কে? -
অজিত কেশকম্বলী
Nov. 19, 2024 | হিন্দুধর্ম | views:877 | likes:1 | share: 0 | comments:0

সম্ভবত আপনারা অনেকেই মনুসংহিতার নাম শুনে থাকবেন। স্ত্রীদের প্রতি ঘৃণা, শূদ্রদের প্রতি অত্যাচার ও জাতিভেদের আকর গ্রন্থ এই মনুসংহিতা। সুচতর ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের সৃষ্ট এই শাস্ত্রে পদে পদে ব্রাহ্মণ্যবাদের জয়জয়কার দেখা যাবে, ব্রাহ্মণকে দেবতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এই মনুসংহিতা। মনুসংহিতার প্রণেতা হিসাবে ঋষি মনু্র নাম অত্যন্ত জনপ্রিয়। বৈদিক সাহিত্য হতে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ সর্বত্রই মনুর উল্লেখ পাওয়া যায়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটি, সেটি হল কয়েক’শ বছর আগেও নিম্নবর্ণের মানুষেরা এই মনুর বিধান অনুসারেই অত্যাচারিত হতেন, এখনও প্রায়ই দলিতদের উপর অত্যাচারের খবর আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়ে থাকে। সুতরাং প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আজ অবধি মনুর আদর্শের ভুত হিন্দুদের পিছু ছাড়েনি।

বিখ্যাত লোকেদের পরিচয় যেমন জানার প্রয়োজন পড়ে, তেমনি কুখ্যাত লোকেদের পরিচয় না জেনেও উপায় থাকে না, মনুর ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য।

  

               ১/হিন্দুদের আদিমতম গ্রন্থ বেদে অসংখ্যবার মনুর উল্লেখ পাওয়া যায়।

  “ হে অগ্নি! দেবগণ প্রথমে তোমাকে নহুষের মনুষ্যরূপধারী সেনাপতি করেছিলেন এবং ইহলোকে মনুর ধর্মোপদেষ্টা করেছিলেন। পুত্র যেন পিতৃতুল্য হয়।“ (ঋগ্বেদ ১/৩১/১১)

   

         “হে বিশুদ্ধ অগ্নি! হে অঙ্গীরা! মনু ও অঙ্গীরা এবং যযাতি ও অন্যান্য পূর্বপুরুষের ন্যায় তুমি সম্মুখবর্তী হয়ে (যজ্ঞ) দেশে গমন কর, দেবসমূহকে আন ও কুশের উপর উপবেশন করাও এবং অভিষ্ট হব্যদান কর।“ (ঋগ্বেদ ১/৩১/১৭)

   

         “হে অগ্নি! তুমি এ যজ্ঞে বসুদের, রুদ্রদের এবং আদিত্যদের অর্চনা কর এবং শোভনীয় যজ্ঞযুক্ত ও জলসেচনকারী মনুজাত জনকেও অর্চনা কর।“ (ঋগ্বেদ ১/৪৫/১)

  

              “আমাদের নতুন স্তুতি হৃদয়জাত ও মিষ্ট জিহ্ব অগ্নির সম্মুখে ব্যপ্ত হোক; মনুর সন্তান মানুষগণ যথাকালে যজ্ঞ সম্পাদন করে ও যজ্ঞান্ন প্রদান করে সে অগ্নিকে সংগ্রামকালে উৎপন্ন করে। (ঋগ্বেদ” ১/৬০/৩)

  

                 “হে অগ্নি! তুমি মনুর অপত্যগণের মধ্যে দেবগণের আহ্বানকারী রূপে অবস্থিতি কর; তুমিই তাদের ধনের স্বামী, তারা স্বীয় শরীরে পুত্র উৎপাদনার্থ শক্তি ইচ্ছা করেছিল এবং মোহত্যাগ করে পুত্রগণের সাথে চিরকাল জীবিত থাকে।“ (ঋগ্বেদ ১/৬৮/৪)

               “দেবগণের আহ্বানকারী, অতিশয় বিদ্বান এবং দেবগণের মধ্যে মেধাবী অগ্নিদেব,মনুর যজ্ঞের ন্যায় আমাদের যজ্ঞে উপবেশন করে দেবগণকে আমাদের হব্যের অভিমুখে শাস্ত্রানুসারে প্রেরণ করুন। হে দ্যাবাপৃথিবী! আমার বিষয় অবগত হও।“ (ঋগ্বেদ ১/১০৫/১৪)

   

          “আমরা যজ্ঞানুষ্ঠান ও আজ্যাদিবিশিষ্ট নমোস্কারোপলক্ষিত স্তোত্র দ্বারা বহু হব্য বিশিষ্ট এবং দেবযজ্ঞে যজ্ঞসাধক অগ্নিকে পরিতোষপূর্বক সেবা করি। সে অগ্নি আমাদের হব্যরূপ অন্য গ্রহণের জন্য ক্ষমবান হয়ে নাশপ্রাপ্ত হবেন না। মাতরিশ্বা মনুর জন্য দূর হতে অগ্নিকে এনে দীপ্ত করেছিলেন, সেরূপ দূর হতে আমাদের যজ্ঞশালায় তিনি আসুন।“ (ঋগ্বেদ ১/১২৮/২)

   

           “হে ইন্দ্র! তুমি সমুদ্রাভিমুখে যাবার জন্য নদীদের গমণশীল রথের ন্যায় অনায়াসে সৃজন করেছ। সংগ্রামকামীগণ যেরূপ রথ সৃজন করে সেরূপ তুমিও করেছ। মনুর জন্য ধেণুগণ যে সর্বার্থপ্রদ হয় এবং সমর্থ মানুষের জন্য ধেণুগণ যেরূপ ক্ষীরপ্রদ হয় সেরূপ অস্মদাভিমুখী নদী সকল একই প্রয়োজনে জল সংগ্রহ করে।“ (ঋগ্বেদ ১/১৩০/৫) 

  

                 “স্বীয় তেজবলে শত্রুদের পরাভব করবার সময় হে অগ্নি! তুমি আমাদের সম্ভোগযোগ্য স্তুতি অবগত হও। তোমার আশ্রয় পেয়ে আমরা মনুর ন্যায় স্তব করি। সে অনুন মধুস্পর্শী ধনপ্রদ অগ্নিকে আমি জুহু ও স্তুতি দ্বারা আহ্বান করি।“ (ঋগ্বেদ ২/১০/৬)

  

                    হে মরুৎগণ ! তোমাদের যে নির্মল ঔষধ আছে, হে অভীষ্টবর্ষিগণ, তোমাদের যে ঔষধ অত্যন্ত সুখকর ও সুখপ্রদ, যে ঔষধ আমাদের পিতা মনু মনোনীত করেছিলেন, রুদ্রের সে সুখকর ভয়হারী ঔষধ আমরা কামনা করছি। (২.৩৩.১৩)।

 

                   (ঋগ্বেদ ৪/২৬/১) এ ইন্দ্র আপনার কীর্তি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন-

   “আমি মনু, আমি সূর্য, আমি মেধাবী কক্ষীবান ঋষি, আমি অর্জুনীর পুত্র কুৎস রিষিকে অলঙ্কৃত করেছি, আমি কবি উশনা, আমাকে দর্শন কর।

   

           “হে অগ্নি! মনুর ন্যায় আমরা তোমাকে ধ্যান ও প্রজ্বলিত করছি; হে অঙ্গীরা! তুমি মনুর ন্যায় যজমানের জন্য দেবগণের পূজা কর।“ (ঋগ্বেদ ৫/২১/১) 

  

                   “মনুকৃত দেবযজ্ঞে তিনটি তেজের আবির্ভাব হয়; মরুৎগণ অন্তরিক্ষে সূর্য, বায়ু, অগ্নিরূপে তিনটি জ্যোতিষ্ক ধারণ করেন। হে ইন্দ্র! বিশুদ্ধ বলসম্পন্ন মরুৎগণ তোমার স্তব করেন, কারণ তুমি সুবুদ্ধিসম্পন্ন এবং এ সকল মরুৎ দর্শন করে।“ (ঋগ্বেদ ৫/২৯/১) 

  

                   “হে বন্ধুগণ! এস, আমরা সে স্তোত্র পাঠ করি, যা দিয়ে অপহৃত ধেণুগণের গোষ্ঠ উদ্ঘাটিত হয়েছিল, যা দিয়ে মনু বিশিশিপ্রকে জয় করেছিলেন যা দিয়ে বণিকের ন্যায় কক্ষীবান জলেচ্ছায় বনে গিয়ে জল লাভ করেছিল।“ (ঋগ্বেদ ৫/৪৫৬) 

                 “হে মহান ইন্দ্র! মনুর ন্যায় কুশ বিস্তারকারী যজমানের অন্নের জন্য এবং সুখের জন্য যে যজ্ঞ আরদ্ধ হয়, অদ্য তোমাদের জন্য ক্ষিপ্র সে যজ্ঞ ঋত্বিকগণের দ্বারা প্রবৃত্ত হয়েছে।“ (ঋগ্বেদ ৬/৬৮/১) 

   

              “হে অগ্নি! ঋত্বিকগণ দিবসে তিন বার হব্যদাতা মনুষ্যের জন্য তোমার মধ্যে হব্য প্রক্ষেপ করে। মনুর ন্যায় এ যজ্ঞে দূত হয়ে যাগ কর এবং আমাদের শত্রু হতে রক্ষা কর।“ (ঋগ্বেদ ৭/১১/৩) 

  

                       “যজ্ঞার্হ দেবগণের ও যজনীয় মনুর, যজনীয় মরণরহিত সত্যজ্ঞ যে দেবগণ আছেন, তারা অদ্য আমাদের বহু কীর্তি যুক্ত পুত্র প্রদান করুন। তোমরা সর্বদা আমাদের স্বস্তি দ্বারা পালন কর।“ (ঋগ্বেদ ৭/৩৫/১৫)

 

                   “তুমি যজ্ঞশীল, কবিপুত্র,জাতবেদা,মনুর গৃহে উশবা তোমাকে হোতারূপে উপবেশন করিয়েছিলেন।“ (ঋগ্বেদ ৮/২৩/১৭)

   

               “হে বরুণ! আমরা মনুর ন্যায় সোম অভিষব করে ও অগ্নি সমিদ্ধ করে, ঘন ঘন হব্য স্থাপন ও বর্হি ছেদন করে তোমাদের আহ্বান করছি” (ঋগ্বেদ ৮/২৭/৭)

  

                      “সমান ক্রোধবিশিষ্ট বিশ্বদেবগণ মনুর উদ্দেশ্যে যুগপৎ দানে প্রবৃত্ত হোন, অদ্য এবং অপর দিনে এবং আমাদের পুত্রের জন্যেও ধনদাতা হোন।“ (ঋগ্বেদ ৮/২৭/২০)

  

                           “হে শত্রু ভক্ষক, মনুর যজ্ঞারহ দেবগণ! তোমরা ত্রয়স্ত্রিংশ, তোমরা এ প্রকারে স্তুত হয়েছ।“ (ঋগ্বেদ ৮/২৯/২)

  

                          “তোমরা আমাদের ত্রাণ কর,তোমরা রক্ষা কর, তোমরা আমাদের মিষ্ট কথা বল। হে দেবগণ! পিতা মনু হতে আগত পথ হতে আমাদের ভ্রষ্ট করো না, দূরবর্তী মার্গ হতেও ভ্রষ্ট করো না।“ (ঋগ্বেদ ৮/২৯/৩)

  

                          “হে ইন্দ্র! বিবস্বান মনুর সোম পূর্বে যেরূপ পান করেছ, ত্রিতের মন যেরূপ যুগিয়েছ, আয়ুর সাথে যেরূপ প্রমত্ত হয়েছে,-“ (ঋগ্বেদ ৮/৫২/১) 

  

                          “যে স্থানে সকল স্তুতিবাক্য রচয়িতারা স্তব করবার জন্য মিলিত হয়, সোমের সে সত্য স্বরূপ স্থান আমরা যেন প্রাপ্ত হই। সে সোম যার জ্যোতি দ্বারা আলোক উদয় হয়ে দিবসের আবির্ভাব করেছে। যার জ্যোতি মনু রক্ষা করেছে এবং দস্যুর দিকে প্রেরিত হয়েছে।“ (ঋগ্বেদ ৯/৯২/৫) 

   

                         “যে সকল দেবতা অতি দূরদেশ হতে এসে মনুষ্যদের সাথে বন্ধুত্ব করেন, যারা বিবস্বানের পুত্র মনুর সন্তানদের অতি সন্তুষ্ট হয়ে তাদের আশ্রয় দান করেন, যারা নহুষপুত্র যযাতির যজ্ঞে অধিষ্ঠান হন, তারা আমাদের মঙ্গল করুন।“ (ঋগ্বেদ ১০/৬৩/১) 

      “মনু অগ্নি প্রজ্বলিত করে শ্রদ্ধাযুক্ত চিত্তে সাতজন হোতা নিয়ে যে সকল দেবতার উদ্দেশ্যে অতি উৎকৃষ্ট হোমের দ্রব্য উৎসর্গ করেছেন, সে সমস্ত দেবতাগণ আমাদের অভয় দান করুন এবং সুখী করুন, আমাদের সকল বিষয়ে সুবিধা করে দিন এবং কল্যাণ বিতরণ করুন।“ (ঋগ্বেদ ১০/৬৩৬/৭) 


      ইন্দ্রের কীর্তি সম্বন্ধে ঋগ্বেদে বলা হচ্ছে-


      “যজ্ঞানুষ্ঠানে নমুচিকে বধ করেছ। দাসজাতীয়কে ঋষির নিকট নিস্তেজ করে দিয়েছ। তুমি মনুকে সুবিস্তীর্ণ পথ সকল প্রস্তুত করে দিয়েছ, সেগুলি দেবলোকে যাবার অতি সরল পথ হয়েছে।“ (ঋগ্বেদ ১০/৭৩/৭)

  

           “যেমন পূর্বকালে মনুর যজ্ঞে সোমরস এসেছিল, সেরূপ এ প্রস্তরের দ্বারা নিষ্পীড়িত সোম জলে প্রবেশ করুন। গাভীদের জলে স্নান করাবার সময়ে এবং গৃহ নির্মাণ কারযে এবং ঘোটকদের স্নান করাবার সময় যজ্ঞকালে এ অবিনাশী সোমরসদের আশ্রয় লওয়া হয়। “ (ঋগ্বেদ ১০/৭৭/৩) 


         ঋগ্বেদে মনুর বারংবার উল্লেখ দেখে মনুকে একজন প্রভাবশালী স্বতন্ত্র মানুষ বলেই মনে হয়।

২/এছাড়াও, তৈত্তিরীয় সংহিতায় মনুর নির্দেশকে ‘ভেষজ’ বলা হয়েছে- “যদ্বৈ কিং চ মনুরবদৎ তদ্ ভেষজম্।”

ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণে “সর্বজ্ঞানময়ো বেদঃ সর্ববেদময়ো মনুঃ” উক্তিটির মাধ্যমে মনুর মধ্যে সমস্ত বেদের জ্ঞান নিহিত আছে বলে প্রশংসা করা হয়েছে।

 

                ছান্দোগ্য উপনিষদে ঋষি বলছেন- “প্রজাপতি (ব্রহ্মা) মনুকে উপদেশ দিয়েছিলেন এবং মনুই প্রজাদের মধ্যে তা প্রচার করেন।”- “প্রজাপতি র্মনবে মনুঃ প্রজাভ্যঃ” (৩.১১.৪)।

  তৈত্তিরিয় সংহিতায় মনু থেকেই প্রজা সৃষ্টি হওয়ার কথা বলা হয়েছে।


           ৩/ রামায়ণের কিস্কিন্ধ্যাকাণ্ডে দেখা যায়, রামচন্দ্রকর্তৃক আহত বানররাজ বালি রামচন্দ্রকে ভর্ৎসনা করলে রামচন্দ্র মনুসংহিতা থেকে দুটো শ্লোক উদ্ধৃত করে নিজ দোষ ক্ষালনে উদ্যোগী হয়েছিলেন-“রাজভিঃ ধৃতদণ্ডাশ্চ কৃত্বা পাপানি মানবাঃ।নির্মলাঃ স্বর্গমায়ান্তি সন্তঃ সুকৃতিনো যথা।।শাননাদ্ বাপি মোক্ষাদ্ বা স্তেনঃ পাপাৎ প্রমুচ্যতে।রাজা ত্বশাসন্ পাপস্য তদবাপ্নোতি কিল্বিষম্ ।।” (১৮/৩১-৩২) অর্থাৎ, মানুষ পাপ করলে যদি রাজা তাকে দণ্ড দেন, তবে সে পাপমুক্ত হয়ে পুণ্যবান ব্যক্তির ন্যায় স্বর্গে যায়; রাজার দ্বারা শাসিত হলে, অথবা বিচারের পর বিমুক্ত হলে, চোর চৌর্যপাপ থেকে মুক্তি লাভ করে। কিন্তু রাজা চোরকে শাসন না করলে তিনি নিজেই ঐ চৌর্যপাপের দ্বারা লিপ্ত হন। রামায়ণে উদ্ধৃত এই শ্লোক দুটি মনুসংহিতার অষ্টম অধ্যায়ের ৩১৬ ও ৩১৮ সংখ্যক শ্লোকে প্রায় একইভাবে পাওয়া যায়।

   

           কোশল দেশে বিখ্যাত অযোধ্যা নগরীর স্রষ্টা হিসাবে রামায়ণে ‘মানবশ্রেষ্ঠ মনু’-র নাম পাওয়া যায়।

“অযোধ্যা নাম তত্রাসিৎ নগরী লোকবিশ্রুতা।

           মনুনা মানবেন্দ্রেণ পুরের পরিনির্মাতা।। (বালকাণ্ড ৫/৬)

           ৪/ মহাভারতেও অসংখ্যবার মনুর উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে কখনো ‘স্বায়ংভুব মনু’ এবং কখনো বা ‘প্রাচেতস মনু’র উক্তি উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে।

            মহাভারতের শান্তিপর্বে (৩৩৬.৩৮-৪৬) বর্ণিত হয়েছে-“পুরুষোত্তম ভগবান ধর্মবিষয়ক লক্ষ শ্লোক রচনা করেছিলেন, যার দ্বারা সমগ্র লোকসমাজের পালনীয় ধর্মের প্রবর্তন হয়েছিলো (লোকতন্ত্রস্য কৃৎস্নস্য যস্মাদ্ ধর্মঃ প্রবর্ততে)। স্বায়ংভুব মনু নিজে ঐ ধর্মগুলি প্রচার করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে উশনাঃ ও বৃহস্পতি মনু-স্বায়ংভুবের গ্রন্থ আশ্রয় করে নিজ নিজ শাস্ত্র রচনা করেছিলেন।–“স্বায়ংভুবেষু ধর্মেষু শাস্ত্রে চৌশনসে কৃতে। বৃহস্পতিমতে চৈব লোকেষু প্রতিচারিতে।।”

                   মহাভারতের শান্তি পর্বে রয়েছে,

   “প্রজেনং স্বেষু দারেষু মার্দবং হ্রীরচাপলম।

  এবং ধর্মং প্রধানেষ্টং মনু স্বায়ম্ভুবোহব্রবিং।।“ (২১/১২)

  অর্থাৎ, স্বায়ম্ভুব মনু বলেছেন- নিজ স্ত্রীতে সন্তান উৎপাদন, ম্রিদুতা, লজ্জ্বা ও অচপলতা প্রভৃতি গুণগুলি অবলম্বন করাই হল শ্রেষ্ঠ ও অভিষ্ট ধর্ম।

                   রাজধর্ম বা রাজনীতিশাস্ত্রের রচয়িতা হিসাবে প্রাচেতস মনুর পরিচয়ও শান্তি পর্বে আছে-

   “প্রাচেতসেন মনুনা শ্লৌকৌ চেমৌ উদাহুতৌ।

  রাজধর্মেষু রাজেন্দ্র তাবিহৈকমনাঃ শৃণু ।।“ (৫৭/৪৩)


                   অর্থাৎ, মহাভারতের বনপরবে (৩৫/২১) মনুর দ্বারা মনুর দ্বারা রাজধর্ম বর্ণিত হওয়ার কথা এবং মনুর সৃষ্ট অর্থবিদ্যার প্রসঙ্গ দ্রোণপর্বে (৭/১) দেখা যায়।


            ৫/ গীতায় কৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন-

“ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবান্ অহমব্যয়ম্।বিবস্বান্ মনবে প্রাহ মনুরিক্ষাকবেহব্রবীৎ।।” (৪.১)

অর্থাৎ আমি ঐ যোগ পুরাকালে বিবস্বানকে বলেছিলেন এবং বিবস্বান নিজপুত্র বৈবস্বত মনুকে বলেছিলাম । পরে বৈবস্বত মনু ঐ যোগ ইক্ষাকুকে বলেছিল।

           

            ৬/ তাছাড়াও, ৮০০ থেকে ৮২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আবির্ভূত টীকাকার বিশ্বরূপ তাঁর যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতার টীকায় মনুসংহিতা থেকে দুশটিরও বেশি শ্লোকের পূর্ণাঙ্গ বা আংশিক উদ্ধৃতি দিয়েছেন বলে P.V. Kane দেখিয়েছেন।

  

                      সপ্তম শতকে আবির্ভূত বিখ্যাত অদ্বৈতবাদী বা মায়াবাদের জনক শঙ্করাচার্য তাঁর বেদান্তসূত্রভাষ্যে প্রায়ই মনুসংহিতা থেকে শ্লোক উদ্ধৃতি দিয়েছেন (উল্লেখ্য, বর্তমানকালের প্রচলিত হিন্দু দর্শন শঙ্কারাচার্যের এই মায়াবাদের উপরই আশ্রিত বলা যায়)।

 

                       ২০০ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক নাটকের নবম অঙ্কে মনুর একটি অনুশাসনের উল্লেখ রয়েছে এভাবে-

                “অয়ং হি পাতকী বিপ্রো ন বধ্যো মনুরব্রবীৎ। রাষ্ট্রাদস্মাত্তু নির্বাস্যো বিভবৈরক্ষতৈঃ সহ।।” অর্থাৎ, মনুর মতানুসারে পাপাচারী ব্রাহ্মণ বধ্য হবেন না, বরং এঁকে এঁর সমস্ত ধন-সম্পদের সাথে রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত করাই বিধি।

             

                   মহাকবি কালিদাস তার রঘুবংশের প্রথম সর্গে দিলিপের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন- এই রাজার শাসন প্রভাবে মনুর সময় থেকে প্রচলিত চিরাচরিত আচারপদ্ধতি থেকে তার প্রজারা বিচলিত হননি।

   “রেখামাত্রমপি ক্ষুণ্ণাদা মনো বর্ত্মনঃ পরম।

  ন ব্যতিয়ুঃ প্রজাস্তস্য নিয়ন্তু র্নেমিবৃত্তয়ঃ” (রঘুবংশ ১/১৭)

  আবার চতুর্দশ সর্গে (৬৭ শ্লোক) কালিদাস বলছেন – রাজা যাতে বর্ণ ও আশ্রম সুরক্ষিত করতে

  পারেন, তার জন্য মনু কিছু ধর্ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।

   “নৃপস্য বর্ণাশ্রমপালনং যৎস এব ধর্মো মনুনা প্রণীতঃ।”

  আবার কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও কয়েকবার মনুর উল্লেখ পাওয়া যায়।

  

               আরেক স্মৃতিশাস্ত্রকার বৃহষ্পতির আবির্ভাবকাল ৫০০ খ্রিস্টাব্দের আগে। তিনিও প্রয়োজনবোধে বহুস্থানে মনুবচন উদ্ধৃত করেছেন। আবার অপরার্ক, কুল্লুক ভট্ট প্রভৃতি ভাষ্যকারগণও নিজ নিজ মন্তব্যের সমর্থনে বৃহষ্পতির ঐ উদ্ধৃতিগুলো উল্লেখ করেছেন।

 

                 যেমন, কুল্লুক ভট্ট মনুসংহিতার প্রথম শ্লোকের টীকায় মনুবচনের প্রশংসাসূচক বৃহষ্পতির দুটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে-“বেদার্থোপনিবন্ধৃত্বাৎ প্রাধান্যং তু মনুস্মৃতৌ। মন্বর্থবিপরীতা যা স্মৃতিঃ সা ন প্রশস্যতে।।” বেদের অর্থ ঠিক ঠিক ভাবে উপস্থাপিত করার জন্যই মনুস্মৃতির প্রাধান্য। যে স্মৃতি মনুবচনের বিরুদ্ধ তা নিন্দনীয়। আবার-

   

           “তাবচ্ছাস্ত্রাণি শোভন্তে তর্কব্যাকরণানি চ। ধর্মার্থমোক্ষোপদেষ্টা মনুর্যাবন্ন দৃশ্যতে।।” তর্ক, ব্যাকরণ প্রভৃতি শাস্ত্র ততক্ষণ পর্যন্তই শোভা পায়, যতক্ষণ মনুস্মৃতি আমাদের দৃষ্টির অগোচরে থাকে। মনু হলেন ধর্ম, অর্থ ও মোক্ষের উপদেষ্টা। বোঝা যাচ্ছে, মনুবচনই বেদবাক্য হিসেবে শিরোধার্য্য হয়ে আছে।


            ৭/ পুরাণে পৃথিবীকে সপ্তদ্বীপা কল্পনা করে সেই সেই দ্বীপে সাতটি জাতির পর্যায়ক্রমে বসতি স্থাপনের উল্লেখ দেখা যায়। এই সাতটি ছিল মূল জাতি। প্রত্যেক মূল জাতির আদি পিতা মনু; ফলে মোট সাতজন মনুর অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এঁরা হলেন- স্বায়ংভুব, স্বারোচিষ, ঔত্তমি, তামস, রৈবত, চাক্ষুষ ও বৈবস্বত। এঁদের মধ্যে বৈবস্বত মনুকে আর্যজাতির আদি পিতারূপে কল্পনা করা হয়েছে। মনুসংহিতায় এই মনুর কথাই বলা হয়েছে ১/৬১-৬৩ শ্লোকে।


            ৮/বিভিন্ন শিলালেখ থেকে মনুর সম্বন্ধে জানা যায়।


            ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতকে প্রচারিত কিছু অভিলেখে স্মৃতি শাস্ত্র রচয়িতা মনুর সশ্রদ্ধ উল্লেখ এবং তার দ্বারা অভিহিত বিধানের উল্লেখ আছে।

  

                   ৫৩৫ ও ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দে বলভী থেকে প্রচারিত রাজা শ্রীধর সেনের অভিলেখে রাজাকে মনু ও অন্যান্যদের প্রণীত বিধি বিধান অনুসরণকারী বলে বর্ণনা করা হয়েছে- ‘মন্বাদি-প্রণীতবিধিবিধান-ধর্মা’

  ৮ম শতক ও তার পরবর্তী বহু তাম্রলিপিতে ‘উক্তঞ্চ মানবে ধর্মে’, ‘তত্র্য মনুগীতা ধর্মা শ্লোকা ভবন্তি’ প্রভৃতি সূচনা দিয়ে শ্লোক উদ্ধৃত করা হয়েছে।


              ৯/ অবশ্য মনুসংহিতা থেকেও মনু সম্বন্ধে জানা যায়।


                মনুসংহিতা মতে, বিরাট পুরুষ বহুকাল তপস্যা করে মনুকে সৃষ্টি করেছিলেন। মনুকে সমুদয় জগতের দ্বিতীয় স্রষ্টা বলা হয়েছে। ১/৩৩

 

                      মনু তপস্যার মাধ্যমে দশজন প্রজা সৃষ্টি করেছিলেন। তারা হল- মরীচি, অত্রি, অঙ্গীরা, পুলহ, পুলস্ত্য, ক্রতু, প্রচেতা, বশিষ্ট, ভৃগু ও নারদ। ১/৩৪-৩৫

  

                         মরীচি প্রভৃতি দশ প্রজাপতি আরও সাতজন মনুকে সৃষ্টি করেছিলেন। ১/৩৬ তাদের নাম হল স্বরোচিষ, ঔত্তমি, তামস, রৈবত, মহাতেজা, চাক্ষুস ও বৈবস্বত। ১/৬১-৬২ অসীম ক্ষমতা সম্পন্ন এই সাতজন মনু নিজ নিজ অধিকার বলে এই চরাচর বিশ্বসংসার সৃষ্টি করে প্রতিপালন করেন। ১/৬৩

  

                          মনুসংহিতা প্রসঙ্গে মনুসংহিতায় বর্ণিত আছে,

  মনুসংহিতায় বলা আছে, হিরণ্যগর্ভ ব্রহ্মা সৃষ্টির প্রথমে এই শাস্ত্র (মনুসংহিতা) প্রস্তুত করে যথাবিধি অধ্যয়ণ করিয়েছিলেন এবং মনু মরীচি প্রভৃতি মুনিগণকে পাঠ করিয়েছিলেন। ১/৫৮

  

                       মহর্ষি ভৃগু মনুর কাছে মনুসংহিতা অধ্যয়ন করেছিলেন এবং তিনিই মনুসংহিতা আদ্যোপান্ত বর্ণনা করেন। ১/৫৯


[লেখাটি সম্পূর্ণ করতে বিশেষভাবে ডাঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর ‘মনুসংহিতা প্রাককথন’ লেখাটির সাহায্য নিয়েছেন লেখক অজিত কেশকম্বলী ।]


RSS একটি তীব্র নারী বিদ্বেষী সংগঠন 

- সৌতিক দাস

     

'আরএসএস'-এর প্রতিষ্ঠা ১৯২৫ সালে৷ প্রতিষ্ঠাতা ডঃ হেডগেওয়ারের পরে এম এস গোলওয়ালকর 'আরএসএস'-এর পরিচালক হন৷ গোলওয়ালকর ১৯৪০ সালে এই দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত টানা ৩৩ বছর 'আরএসএস'-এর পরিচালক এর দায়িত্ব সামলেছিলেন। 

       ফ্ল্যাশব্যাক ১৯৬০, ডিসেম্বর ১৭; গুজরাট ইউনিভার্সিটিতে স্টুডেন্ট-দের উদ্দেশে লেকচার দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পেলেন 'আরএসএস'-এর দ্বিতীয় সঙ্ঘচালক এম এস গোলওয়ালকর। সেখানে তিনি বলেন- "আজ ক্রস-ব্রিডিংয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেবল প্রাণীদের উপর করা হয়। কিন্তু মানুষের উপর এ জাতীয় পরীক্ষা করার সাহস আজকের তথাকথিত আধুনিক বিজ্ঞানীও দেখাননি। ...যে কোনও শ্রেণির বিবাহিত মহিলার প্রথম সন্তান অবশ্যই নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ দ্বারা জন্মগ্রহণ করা উচিত এবং তারপরে তিনি তার স্বামী দ্বারা সন্তানের জন্ম দিতে পারেন।"

      পরবর্তীকালে 'আরএসএস'-এর মুখপত্র 'অর্গানাইজার' পত্রিকাতে ১৯৬১ সালের ২ জানুয়ারী ৫ নম্বর পৃষ্ঠাতে এই খবরটি ছাপা হয়েছিল।  

       অর্থাৎ ওঁর ওই বক্তব্যের সারমর্ম করলে এই দাঁড়ায় যে, আপনি যদি মহিলা হন আর কোনও সন্তানের মা হতে চান তবে আপনার স্বামীর বদলে নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের কোনও পুরুষের সাথে আপনাকে সেক্স করতে হবে যতদিন পর্যন্ত না আপনি প্রেগন্যান্ট হচ্ছেন। তারপর সেই পুরুষের ঔরসজাত সন্তান আপনার গর্ভে আসার পর দ্বিতীয় সন্তান আপনি আপনার স্বামীর সাথে সেক্স করে নিতে পারেন। 

       ফ্ল্যাশব্যাক ২০১৩, জানুয়ারি ৬ ; 'আরএসএস'-এর প্রধান শ্রী মোহন ভাগবত ইন্দোরের একটি জনসভা থেকে বলে উঠলেন- "বিবাহ হল চুক্তি। ছেলেরা বিবাহ করে সুখ পাওয়ার জন্যে, আর মেয়েরা বিয়ে করে ছেলেদের সুখ দেওয়ার বিনিময়ে নিজেদের পেট চালানোর জন্য। এই চুক্তি মেয়েরা যদি পূরণ করতে না পারে তাহলে পুরুষদের ওদের ছেড়ে দেওয়া উচিত।" 

       'আরএসএস'-এর দ্বিতীয় সঙ্ঘ-চালক গোলওয়ালকার তাঁর ‘বাঞ্চ অফ থটস’ বইয়ে ২৩৮ পৃষ্ঠায় গণপরিষদকে তুলোধোনা করে ভারতীয় সংবিধান সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছিলেন, জাতীয় লক্ষ্য, জীবন দর্শনের কোনও পথনির্দেশই সংবিধানে নেই, কোনও নিজস্বতাও নেই, কারণ গণ পরিষদের পণ্ডিতরা 'মনুস্মৃতি'র মত প্রাচীন ভারতের নৈতিক ও কার্যকরী আইনকে সংবিধানে জায়গা দেওয়ার প্রয়োজন বোধই করেননি। 

বাবাসাহেব আম্বেদকর রচিত ভারতীয় সংবিধানের বদলে 'আরএসএস' সেই 'মনুস্মৃতি'কে ভারতের সংবিধান হিসেবে চেয়েছিলো যে, 'মনুস্মৃতি'র প্রতিটি পদে পদে নারী জাতির প্রতি চূড়ান্ত অসম্মানের, নারী বিদ্বেষের ইতিহাস লেখা আছে। 


      ১৯২৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাবাসাহেব ড. ভীমরাও আম্বেদকরের নেতৃত্বে 'মনুস্মৃতি' পুড়িয়ে দিয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেখানোর ঘটনা আরও বেশি বেশি করে প্রমাণ করে, এই বইটির ছত্রে ছত্রে আছে শুধুই বিদ্বেষের সুর।

  

      'মনুস্মৃতি'তে মোট দু’হাজার সাতশো শ্লোক ও ১২ টি অধ্যায় আছে। এই মনুশাস্ত্রে কোথাও নারীকে শূদ্রের চেয়ে বেশি মর্যাদা দেয়া হয়েছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। নারীকে স্বভাবজাত দাসী বানিয়েই রাখা হয়েছে।

       মনুশাস্ত্রে নারী হচ্ছে, পুরুষের ইচ্ছাধীন এক যন্ত্র যাতে পুরুষপ্রভু তার বীর্যরূপ বীজ বপন করে পুত্ররূপ শস্য হিসেবে যোগ্য উত্তরাধিকারী উৎপাদনের মাধ্যমে ধর্মরূপ পুরুষতন্ত্রের বহমান ধারাটিকে সচল রাখতে পারবে। এখানে নারী কেবলই এক পুরুষোপভোগ্য জৈবসত্তা। নারীর মনস্তত্ত্ব বা কোনওরূপ মানসিক সত্তাকে মনুশান্ত্রে স্বীকারই করা হয়নি। নারীর দেহসত্তাটিরই প্রাধান্য এখানে, যার মালিকানাও নারীর নিজের নয় অবশ্যই। এর মালিকানা শুধুই আধিপত্যকামী পুরুষ প্রভুর। পুরুষতন্ত্র তার ইচ্ছানুরূপ শারীরিক-মানসিক ভোগ-লিপ্সা চরিতার্থ করতে পারবে। 


        'মনুস্মৃতি'র ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে থাকা এই নারী বিদ্বেষের কথার সাথে গোলওয়ালকর, মোহন ভাগবতদের সুর মিলে যাচ্ছে তো!

        

        সেই কারণেই সেদিন 'আরএসএস', বাবাসাহেব আম্বেদকর রচিত ভারতীয় সংবিধানের বদলে এই 'মনুস্মৃতি'কে ভারতের সংবিধান হিসেবে চেয়েছিল।

        আমি আমার সীমিত ক্ষমতা দিয়ে সারাজীবন এদের বিরোধীতা করে যাব। আমার আশেপাশের সাধারণ মানুষকে এভাবেই বার বার বুঝিয়ে যাব যে, 'আরএসএস' শুধু একটি দেশদ্রোহীদের সংগঠন না তার সাথে একটি তীব্র নারী বিদ্বেষী সংগঠনও। 


        সবাইকে ভালোবাসা যায় না, কাউকে কাউকে ঘৃণা করতেও জানতে হয়। আমি আমার সীমিত ক্ষমতা দিয়ে এদেরকে ঘৃণা করতাম, ঘৃণা করি আর আজীবন করে যাব। 

        কথা দিলাম আপনিও যেদিন 'আরএসএসে'র পুরো ইতিহাস পড়ে ফেলবেন, জেনে ফেলবেন, বিশ্বাস করুন ঠিক সেদিন আপনিও ঘৃণাতে বমি করে ফেলবেন।

ওয়াক থুঃ!‌


লোক ঠকানোর ধান্দাবাজি: বাটি চালানোর মূল রহস্য!

-এস এ খান


বাটি চালানোতেই যদি কাজ হতো তবে পুলিশ, গোয়েন্দা, সি বি আই, সি আই ডি, “ডগ স্কোয়াড” না রেখে “বাটি চালানো স্কোয়াড” রাখা হতো! এর কোনও বৈজ্ঞানিক কৌশল নেই’ই এমনকি এমন ঘটার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও নেই। যেটা আছে সেটা হল ভাঁওতাবাজি এবং “সফল বাটি চালানোর” কেস স্টাডিতে পাওয়া যায় “অভ্যন্তরীণ রাজনীতি” আর অপরাধীকে আড়াল করে কোনও "সজ্জন ব্যক্তিকে ফাঁসানোর" মারপ্যাঁচ ।


         প্রথমেই তথাকথিত “বাটি চালনো” পদ্ধতিটা জেনে নেওয়া যাক, যেটার কথা বলা হয়ে থাকে :

১. তান্ত্রিক সাধু লোক তার তন্ত্র-মন্ত্র পড়ে বা আগে থেকে “পড়ে রাখা” বাটি রাখবে মাটিতে।

২. তথাকথিত “তুলা রাশির জাতক”কে সেটা হাত দিয়ে ধরতে হবে, কেউ কেউ বাটিতে হাত রাখতে বলে, কখনও হাতে লাঠি নিয়ে লাঠির মুক্তপ্রান্ত বাটির মধ্যে রাখতে বলা হয়।

৩. বাটি চলা শুরু করে ও কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে চলে যায় ধরে রাখা ব্যক্তিটাকে নিয়ে।


        প্রথমেই পরিষ্কার মনে রাখা প্রয়োজন, পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম লঙ্ঘন করে বাটির নিজে নিজে চলা সম্ভব নয়। 


        কোনও বস্তুকে স্থির অবস্থা থেকে নাড়াতে চাইলে আপনাকে এর ওপর বল প্রয়োগ করতে হবে। বাটির ওপর যান্ত্রিক শক্তি প্রয়োগ করতে পারেন; বাটি যদি লৌহজাতীয় ধাতুর তৈরি হয় সেক্ষেত্রে চৌম্বক শক্তি প্রয়োগ করতে পারেন; এমনকি রাসায়নিক বিক্রিয়া ব্যবহার করেও শক্তি উৎপন্ন করে কাজে লাগানো যায়। ধান্দাবাজদের বাটি চালানোর ক্ষেত্রে আসি। ইশারায় যদি কোনও বস্তুকে নাড়ানো হয়- তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ইশারা থেকে উৎপন্ন শক্তি বাটিকে নাড়াচ্ছে। এই ব্যাপারটি যদি সত্যি ঘটে থাকে, তাহলে তা এসব ছোটখাট কাজে ব্যবহার না করে বড় কাজে ব্যবহার করা যায়।


        যেমন, যেসব ওঝা /তান্ত্রিক /বাবা ইশারায় বাটি নাড়ান তারা একত্র হয়ে একটি পরিবহন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। এই সংস্থা কোনও জ্বালানি বা শক্তি প্রয়োগ ছাড়াই বস্তু সরানোর কাজ করে দেবে। এতে পৃথিবীর জ্বালানি সমস্যা মিটে যাবে। নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসও খুঁজতে হবে না। মহাকাশে যান পাঠাতে আর জ্বালানি লাগবে না, তাদের ইশারার মিলিত শক্তি সেগুলোকে অরবিটে পাঠিয়ে দেবে। বাস, ট্রাক, প্লেনে এইসব লোককে নিয়োগ করা যায়। তাদের ইশারা থেকে প্রাপ্ত শক্তি ব্যবহার করে যানবাহন চলবে। পৃথিবীর শক্তি বিষয়ক যাবতীয় সমস্যা মিটে যাবে। পৃথিবী হয়ে উঠবে শক্তি আত্মনির্ভর!


         যাই হোক, আসল কথা বলি- বাটি চালান দিয়ে কখনোই ইশারার মাধ্যমে বাটি নাড়ানো সম্ভব না। তা সম্ভব হলে পদার্থবিদ্যা সূত্রগুলো নতুন করে লিখতে হবে, আর এরা পাবেন নোবেল পুরষ্কার। এই জাতীয় ঘটনাগুলোয় সবসময়ই কোনও না কোনও কৌশল ব্যবহার করা হয়। ঠিক যেমন যাদুকরেরা তাদের কৌশল ব্যবহার করে আমাদের চোখে ধুলো দেয়। আর ওঝা / তান্ত্রিক/ হুজুর  / বাবাদের হাত থেকে যদি নিজের আত্মীয়পরিজনকে বাঁচাতে চান তাহলে তাদেরকে হয়- পদার্থবিজ্ঞান শেখাতে পারেন, নয়তো স্রেফ বলতে পারেন যে, ধর্মে যাদুবিদ্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমি নিশ্চিত, এটা কাজ করবে!


         এখন আসি ঘটনা বিশ্লেষণে। সে ক্ষেত্রে জানিয়ে রাখি দুটো বিষয়:

১. এধরনের ঘটনায় বহুবার বাটি না নড়ার এবং বহুবার কাঙ্ক্ষিত স্থানে না পৌঁছাবার ঘটনা ঘটে এবং প্রায়শই যাদের পরিবারে বাটি চালান পদ্ধতি প্রয়োগের ঘটনা ঘটে থাকে তাদের ফলাফল না পাবার ঘটনা জানা থাকবার কথা। (তারপরেও আস্থা কীভাবে থাকে সেটা বোধগম্য নয়)


২. তান্ত্রিক/বাবা/ওঝা ব্যক্তি পইপই করে বলতে থাকে “আমার উপরে বিশ্বাস রাখতে হবে সবার, আমার তন্ত্রের উপরে বিশ্বাস রাখতে হবে সবার, নয়ত চালান কাজ করবে না।” এটা হল সেইফ জোনে যাওয়ার সেরা উপায়। কাজ না করলেই বলে ফেলা যায়। আপনাদের মধ্যে কেউ হয়ত আমাকে, আমার তন্ত্রকে বিশ্বাস করেননি। তাই হয়নি।


এবার দেখা যাক কী ঘটে? 

যখন তান্ত্রিক নিজেই “তুলা রাশির জাতক” সাপ্লায়ার তখন বলাই বাহুল্য সাপ্লায়ার নিজেই বাটি চালনার চালিকা শক্তির উৎস এবং নিজেই ঠেলে নিয়ে যায়। সম্ভাব্য কোনও স্থানে। মিলে গেলে কাকতালীয় বাহবা, আর না মিললে উপরে ২ নম্বর পয়েন্ট হড়বড় করে বলে দেওয়া।

যখন পরিবারের কেউ বা বাইরের কোনও ভলান্টিয়ারকে বাটিতে হাত রাখতে বলা হত তখন দুটো ঘটনা ঘটতে পারে।

১. যদি ভলান্টিয়ার নিজে বেশ গভীরভাবে মনে করে “বাটি চালান” কাজ করেই তবে সে হাত রাখার পরে অজান্তেই তার মনে হয় বাটি নড়ছে। এতে সে নিজেও ওইদিকে হাত নাড়ায় ফলে বাটি এগোতে থাকে। আর একবারে এগিয়ে গেলে সেটা আরও পেয়ে বসে ও কোনও একটা জায়গায় গিয়ে থামে। ভলান্টিয়ার বুঝতেও পারে না সে নিজেই নিয়ে যাচ্ছে বাটি। তার মনে হয় বাটিই তাকে নিয়ে যাচ্ছে। এটা সম্পূর্ণই মানসিকে চাপ ও সাব-কনশাস মাইন্ডের খেলা।


২. শুরুতে যে রাজনীতির কথা বলেছিলাম এখন সেটাই বলছি। এটা আমার নিজের ছোট সময়ের একটা ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে সংগৃহীত। ওদিনই বুঝে গিয়েছিলাম, বাটি চালান “বড়দের একটা পাতানো খেলা” মাত্র।


        সচরাচর যদি খুব দামী কিছু খোয়া যায় যেমন, স্বর্ণালংকার বা বড় অংকের টাকা বা ধরুন, এখন দামী মোবাইল এবং ধারণা করা হয় চুরি হয়ে বাইরে যায়নি তাহলে সেটা খুঁজতে “বাটি চালান” পদ্ধতি এখনও অনেকে অবলম্বন করে।

এক্ষেত্রে যদি অপরাধী সেখানে থেকেই থাকে এবং পরিবারে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের কেউ হয় এবং সেও মনেপ্রাণে ধরে নেয় “বাটি চালান দিলে তো আমি ধরা পড়েছি”।


         তাহলে সম্মান বাঁচাতে যে ঘটনাটা ঘটে –

সে বাঁচতে স্বীকার করার সিদ্ধান্ত নেয়, সবার সামনে ধরা পড়লে মান-সম্মান যাবে এই ভয়ে। তখন সে এমন কাউকে বলে যে তাকে মারবে না। তখন সে তেমনই একজন মুরুব্বির/মোড়ল/পাড়ার দাদার হাতে পায়ে ধরে নাকের জল চোখের জল এক করে মাফ চায় এবং জিনিস ফেরত দেয়।

মুরুব্বি/মোড়ল তাকে ও পরিবারের সম্মান বাঁচাতে বাড়ির কোনও অন্ধকার ঘুপচিতে জিনিসটা লুকিয়ে রাখে। ঘরের “তুলা রাশির জাতক”কে সাইডে নিয়ে সেট আপ দেয়, পুরা ঘটনাটা বুঝিয়ে দেয় কীভাবে কী করতে হবে মানরক্ষার্থে। যথাসময়ে সেই সেট আপ হওয়া তুলা রাশির জাতক বাটি সেই মুরুব্বির/মোড়লের পূর্ব লুকানো স্থানে নিয়ে যায়। জিনিস পাওয়া যায়, অপরাধী উলালা উলালা আর এইদিকে তান্ত্রিক রকস।

এটাই হচ্ছে বেশিরভাগ সফল বাটি চালানের “অভ্যন্তরীণ রাজনীতি”।

          এছাড়াও কাউকে চাপ দিয়ে টাকা আদায় করতে বা অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে তার সম্পত্তি দখল নিতেও অনেকে তান্ত্রিক / ওঝার সঙ্গে জোট বাঁধে। আখের গুছোয়। 

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86930