সম্ভবত আপনারা অনেকেই মনুসংহিতার নাম শুনে থাকবেন। স্ত্রীদের প্রতি ঘৃণা, শূদ্রদের প্রতি অত্যাচার ও জাতিভেদের আকর গ্রন্থ এই মনুসংহিতা। সুচতর ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের সৃষ্ট এই শাস্ত্রে পদে পদে ব্রাহ্মণ্যবাদের জয়জয়কার দেখা যাবে, ব্রাহ্মণকে দেবতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এই মনুসংহিতা। মনুসংহিতার প্রণেতা হিসাবে ঋষি মনু্র নাম অত্যন্ত জনপ্রিয়। বৈদিক সাহিত্য হতে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ সর্বত্রই মনুর উল্লেখ পাওয়া যায়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটি, সেটি হল কয়েক’শ বছর আগেও নিম্নবর্ণের মানুষেরা এই মনুর বিধান অনুসারেই অত্যাচারিত হতেন, এখনও প্রায়ই দলিতদের উপর অত্যাচারের খবর আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়ে থাকে। সুতরাং প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আজ অবধি মনুর আদর্শের ভুত হিন্দুদের পিছু ছাড়েনি।
বিখ্যাত লোকেদের পরিচয় যেমন জানার প্রয়োজন পড়ে, তেমনি কুখ্যাত লোকেদের পরিচয় না জেনেও উপায় থাকে না, মনুর ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য।
১/হিন্দুদের আদিমতম গ্রন্থ বেদে অসংখ্যবার মনুর উল্লেখ পাওয়া যায়।
“ হে অগ্নি! দেবগণ প্রথমে তোমাকে নহুষের মনুষ্যরূপধারী সেনাপতি করেছিলেন এবং ইহলোকে মনুর ধর্মোপদেষ্টা করেছিলেন। পুত্র যেন পিতৃতুল্য হয়।“ (ঋগ্বেদ ১/৩১/১১)
“হে বিশুদ্ধ অগ্নি! হে অঙ্গীরা! মনু ও অঙ্গীরা এবং যযাতি ও অন্যান্য পূর্বপুরুষের ন্যায় তুমি সম্মুখবর্তী হয়ে (যজ্ঞ) দেশে গমন কর, দেবসমূহকে আন ও কুশের উপর উপবেশন করাও এবং অভিষ্ট হব্যদান কর।“ (ঋগ্বেদ ১/৩১/১৭)
“হে অগ্নি! তুমি এ যজ্ঞে বসুদের, রুদ্রদের এবং আদিত্যদের অর্চনা কর এবং শোভনীয় যজ্ঞযুক্ত ও জলসেচনকারী মনুজাত জনকেও অর্চনা কর।“ (ঋগ্বেদ ১/৪৫/১)
“আমাদের নতুন স্তুতি হৃদয়জাত ও মিষ্ট জিহ্ব অগ্নির সম্মুখে ব্যপ্ত হোক; মনুর সন্তান মানুষগণ যথাকালে যজ্ঞ সম্পাদন করে ও যজ্ঞান্ন প্রদান করে সে অগ্নিকে সংগ্রামকালে উৎপন্ন করে। (ঋগ্বেদ” ১/৬০/৩)
“হে অগ্নি! তুমি মনুর অপত্যগণের মধ্যে দেবগণের আহ্বানকারী রূপে অবস্থিতি কর; তুমিই তাদের ধনের স্বামী, তারা স্বীয় শরীরে পুত্র উৎপাদনার্থ শক্তি ইচ্ছা করেছিল এবং মোহত্যাগ করে পুত্রগণের সাথে চিরকাল জীবিত থাকে।“ (ঋগ্বেদ ১/৬৮/৪)
“দেবগণের আহ্বানকারী, অতিশয় বিদ্বান এবং দেবগণের মধ্যে মেধাবী অগ্নিদেব,মনুর যজ্ঞের ন্যায় আমাদের যজ্ঞে উপবেশন করে দেবগণকে আমাদের হব্যের অভিমুখে শাস্ত্রানুসারে প্রেরণ করুন। হে দ্যাবাপৃথিবী! আমার বিষয় অবগত হও।“ (ঋগ্বেদ ১/১০৫/১৪)
“আমরা যজ্ঞানুষ্ঠান ও আজ্যাদিবিশিষ্ট নমোস্কারোপলক্ষিত স্তোত্র দ্বারা বহু হব্য বিশিষ্ট এবং দেবযজ্ঞে যজ্ঞসাধক অগ্নিকে পরিতোষপূর্বক সেবা করি। সে অগ্নি আমাদের হব্যরূপ অন্য গ্রহণের জন্য ক্ষমবান হয়ে নাশপ্রাপ্ত হবেন না। মাতরিশ্বা মনুর জন্য দূর হতে অগ্নিকে এনে দীপ্ত করেছিলেন, সেরূপ দূর হতে আমাদের যজ্ঞশালায় তিনি আসুন।“ (ঋগ্বেদ ১/১২৮/২)
“হে ইন্দ্র! তুমি সমুদ্রাভিমুখে যাবার জন্য নদীদের গমণশীল রথের ন্যায় অনায়াসে সৃজন করেছ। সংগ্রামকামীগণ যেরূপ রথ সৃজন করে সেরূপ তুমিও করেছ। মনুর জন্য ধেণুগণ যে সর্বার্থপ্রদ হয় এবং সমর্থ মানুষের জন্য ধেণুগণ যেরূপ ক্ষীরপ্রদ হয় সেরূপ অস্মদাভিমুখী নদী সকল একই প্রয়োজনে জল সংগ্রহ করে।“ (ঋগ্বেদ ১/১৩০/৫)
“স্বীয় তেজবলে শত্রুদের পরাভব করবার সময় হে অগ্নি! তুমি আমাদের সম্ভোগযোগ্য স্তুতি অবগত হও। তোমার আশ্রয় পেয়ে আমরা মনুর ন্যায় স্তব করি। সে অনুন মধুস্পর্শী ধনপ্রদ অগ্নিকে আমি জুহু ও স্তুতি দ্বারা আহ্বান করি।“ (ঋগ্বেদ ২/১০/৬)
হে মরুৎগণ ! তোমাদের যে নির্মল ঔষধ আছে, হে অভীষ্টবর্ষিগণ, তোমাদের যে ঔষধ অত্যন্ত সুখকর ও সুখপ্রদ, যে ঔষধ আমাদের পিতা মনু মনোনীত করেছিলেন, রুদ্রের সে সুখকর ভয়হারী ঔষধ আমরা কামনা করছি। (২.৩৩.১৩)।
(ঋগ্বেদ ৪/২৬/১) এ ইন্দ্র আপনার কীর্তি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন-
“আমি মনু, আমি সূর্য, আমি মেধাবী কক্ষীবান ঋষি, আমি অর্জুনীর পুত্র কুৎস রিষিকে অলঙ্কৃত করেছি, আমি কবি উশনা, আমাকে দর্শন কর।
“হে অগ্নি! মনুর ন্যায় আমরা তোমাকে ধ্যান ও প্রজ্বলিত করছি; হে অঙ্গীরা! তুমি মনুর ন্যায় যজমানের জন্য দেবগণের পূজা কর।“ (ঋগ্বেদ ৫/২১/১)
“মনুকৃত দেবযজ্ঞে তিনটি তেজের আবির্ভাব হয়; মরুৎগণ অন্তরিক্ষে সূর্য, বায়ু, অগ্নিরূপে তিনটি জ্যোতিষ্ক ধারণ করেন। হে ইন্দ্র! বিশুদ্ধ বলসম্পন্ন মরুৎগণ তোমার স্তব করেন, কারণ তুমি সুবুদ্ধিসম্পন্ন এবং এ সকল মরুৎ দর্শন করে।“ (ঋগ্বেদ ৫/২৯/১)
“হে বন্ধুগণ! এস, আমরা সে স্তোত্র পাঠ করি, যা দিয়ে অপহৃত ধেণুগণের গোষ্ঠ উদ্ঘাটিত হয়েছিল, যা দিয়ে মনু বিশিশিপ্রকে জয় করেছিলেন যা দিয়ে বণিকের ন্যায় কক্ষীবান জলেচ্ছায় বনে গিয়ে জল লাভ করেছিল।“ (ঋগ্বেদ ৫/৪৫৬)
“হে মহান ইন্দ্র! মনুর ন্যায় কুশ বিস্তারকারী যজমানের অন্নের জন্য এবং সুখের জন্য যে যজ্ঞ আরদ্ধ হয়, অদ্য তোমাদের জন্য ক্ষিপ্র সে যজ্ঞ ঋত্বিকগণের দ্বারা প্রবৃত্ত হয়েছে।“ (ঋগ্বেদ ৬/৬৮/১)
“হে অগ্নি! ঋত্বিকগণ দিবসে তিন বার হব্যদাতা মনুষ্যের জন্য তোমার মধ্যে হব্য প্রক্ষেপ করে। মনুর ন্যায় এ যজ্ঞে দূত হয়ে যাগ কর এবং আমাদের শত্রু হতে রক্ষা কর।“ (ঋগ্বেদ ৭/১১/৩)
“যজ্ঞার্হ দেবগণের ও যজনীয় মনুর, যজনীয় মরণরহিত সত্যজ্ঞ যে দেবগণ আছেন, তারা অদ্য আমাদের বহু কীর্তি যুক্ত পুত্র প্রদান করুন। তোমরা সর্বদা আমাদের স্বস্তি দ্বারা পালন কর।“ (ঋগ্বেদ ৭/৩৫/১৫)
“তুমি যজ্ঞশীল, কবিপুত্র,জাতবেদা,মনুর গৃহে উশবা তোমাকে হোতারূপে উপবেশন করিয়েছিলেন।“ (ঋগ্বেদ ৮/২৩/১৭)
“হে বরুণ! আমরা মনুর ন্যায় সোম অভিষব করে ও অগ্নি সমিদ্ধ করে, ঘন ঘন হব্য স্থাপন ও বর্হি ছেদন করে তোমাদের আহ্বান করছি” (ঋগ্বেদ ৮/২৭/৭)
“সমান ক্রোধবিশিষ্ট বিশ্বদেবগণ মনুর উদ্দেশ্যে যুগপৎ দানে প্রবৃত্ত হোন, অদ্য এবং অপর দিনে এবং আমাদের পুত্রের জন্যেও ধনদাতা হোন।“ (ঋগ্বেদ ৮/২৭/২০)
“হে শত্রু ভক্ষক, মনুর যজ্ঞারহ দেবগণ! তোমরা ত্রয়স্ত্রিংশ, তোমরা এ প্রকারে স্তুত হয়েছ।“ (ঋগ্বেদ ৮/২৯/২)
“তোমরা আমাদের ত্রাণ কর,তোমরা রক্ষা কর, তোমরা আমাদের মিষ্ট কথা বল। হে দেবগণ! পিতা মনু হতে আগত পথ হতে আমাদের ভ্রষ্ট করো না, দূরবর্তী মার্গ হতেও ভ্রষ্ট করো না।“ (ঋগ্বেদ ৮/২৯/৩)
“হে ইন্দ্র! বিবস্বান মনুর সোম পূর্বে যেরূপ পান করেছ, ত্রিতের মন যেরূপ যুগিয়েছ, আয়ুর সাথে যেরূপ প্রমত্ত হয়েছে,-“ (ঋগ্বেদ ৮/৫২/১)
“যে স্থানে সকল স্তুতিবাক্য রচয়িতারা স্তব করবার জন্য মিলিত হয়, সোমের সে সত্য স্বরূপ স্থান আমরা যেন প্রাপ্ত হই। সে সোম যার জ্যোতি দ্বারা আলোক উদয় হয়ে দিবসের আবির্ভাব করেছে। যার জ্যোতি মনু রক্ষা করেছে এবং দস্যুর দিকে প্রেরিত হয়েছে।“ (ঋগ্বেদ ৯/৯২/৫)
“যে সকল দেবতা অতি দূরদেশ হতে এসে মনুষ্যদের সাথে বন্ধুত্ব করেন, যারা বিবস্বানের পুত্র মনুর সন্তানদের অতি সন্তুষ্ট হয়ে তাদের আশ্রয় দান করেন, যারা নহুষপুত্র যযাতির যজ্ঞে অধিষ্ঠান হন, তারা আমাদের মঙ্গল করুন।“ (ঋগ্বেদ ১০/৬৩/১)
“মনু অগ্নি প্রজ্বলিত করে শ্রদ্ধাযুক্ত চিত্তে সাতজন হোতা নিয়ে যে সকল দেবতার উদ্দেশ্যে অতি উৎকৃষ্ট হোমের দ্রব্য উৎসর্গ করেছেন, সে সমস্ত দেবতাগণ আমাদের অভয় দান করুন এবং সুখী করুন, আমাদের সকল বিষয়ে সুবিধা করে দিন এবং কল্যাণ বিতরণ করুন।“ (ঋগ্বেদ ১০/৬৩৬/৭)
ইন্দ্রের কীর্তি সম্বন্ধে ঋগ্বেদে বলা হচ্ছে-
“যজ্ঞানুষ্ঠানে নমুচিকে বধ করেছ। দাসজাতীয়কে ঋষির নিকট নিস্তেজ করে দিয়েছ। তুমি মনুকে সুবিস্তীর্ণ পথ সকল প্রস্তুত করে দিয়েছ, সেগুলি দেবলোকে যাবার অতি সরল পথ হয়েছে।“ (ঋগ্বেদ ১০/৭৩/৭)
“যেমন পূর্বকালে মনুর যজ্ঞে সোমরস এসেছিল, সেরূপ এ প্রস্তরের দ্বারা নিষ্পীড়িত সোম জলে প্রবেশ করুন। গাভীদের জলে স্নান করাবার সময়ে এবং গৃহ নির্মাণ কারযে এবং ঘোটকদের স্নান করাবার সময় যজ্ঞকালে এ অবিনাশী সোমরসদের আশ্রয় লওয়া হয়। “ (ঋগ্বেদ ১০/৭৭/৩)
ঋগ্বেদে মনুর বারংবার উল্লেখ দেখে মনুকে একজন প্রভাবশালী স্বতন্ত্র মানুষ বলেই মনে হয়।
২/এছাড়াও, তৈত্তিরীয় সংহিতায় মনুর নির্দেশকে ‘ভেষজ’ বলা হয়েছে- “যদ্বৈ কিং চ মনুরবদৎ তদ্ ভেষজম্।”
ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণে “সর্বজ্ঞানময়ো বেদঃ সর্ববেদময়ো মনুঃ” উক্তিটির মাধ্যমে মনুর মধ্যে সমস্ত বেদের জ্ঞান নিহিত আছে বলে প্রশংসা করা হয়েছে।
ছান্দোগ্য উপনিষদে ঋষি বলছেন- “প্রজাপতি (ব্রহ্মা) মনুকে উপদেশ দিয়েছিলেন এবং মনুই প্রজাদের মধ্যে তা প্রচার করেন।”- “প্রজাপতি র্মনবে মনুঃ প্রজাভ্যঃ” (৩.১১.৪)।
তৈত্তিরিয় সংহিতায় মনু থেকেই প্রজা সৃষ্টি হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
৩/ রামায়ণের কিস্কিন্ধ্যাকাণ্ডে দেখা যায়, রামচন্দ্রকর্তৃক আহত বানররাজ বালি রামচন্দ্রকে ভর্ৎসনা করলে রামচন্দ্র মনুসংহিতা থেকে দুটো শ্লোক উদ্ধৃত করে নিজ দোষ ক্ষালনে উদ্যোগী হয়েছিলেন-“রাজভিঃ ধৃতদণ্ডাশ্চ কৃত্বা পাপানি মানবাঃ।নির্মলাঃ স্বর্গমায়ান্তি সন্তঃ সুকৃতিনো যথা।।শাননাদ্ বাপি মোক্ষাদ্ বা স্তেনঃ পাপাৎ প্রমুচ্যতে।রাজা ত্বশাসন্ পাপস্য তদবাপ্নোতি কিল্বিষম্ ।।” (১৮/৩১-৩২) অর্থাৎ, মানুষ পাপ করলে যদি রাজা তাকে দণ্ড দেন, তবে সে পাপমুক্ত হয়ে পুণ্যবান ব্যক্তির ন্যায় স্বর্গে যায়; রাজার দ্বারা শাসিত হলে, অথবা বিচারের পর বিমুক্ত হলে, চোর চৌর্যপাপ থেকে মুক্তি লাভ করে। কিন্তু রাজা চোরকে শাসন না করলে তিনি নিজেই ঐ চৌর্যপাপের দ্বারা লিপ্ত হন। রামায়ণে উদ্ধৃত এই শ্লোক দুটি মনুসংহিতার অষ্টম অধ্যায়ের ৩১৬ ও ৩১৮ সংখ্যক শ্লোকে প্রায় একইভাবে পাওয়া যায়।
কোশল দেশে বিখ্যাত অযোধ্যা নগরীর স্রষ্টা হিসাবে রামায়ণে ‘মানবশ্রেষ্ঠ মনু’-র নাম পাওয়া যায়।
“অযোধ্যা নাম তত্রাসিৎ নগরী লোকবিশ্রুতা।
মনুনা মানবেন্দ্রেণ পুরের পরিনির্মাতা।। (বালকাণ্ড ৫/৬)
৪/ মহাভারতেও অসংখ্যবার মনুর উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে কখনো ‘স্বায়ংভুব মনু’ এবং কখনো বা ‘প্রাচেতস মনু’র উক্তি উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে।
মহাভারতের শান্তিপর্বে (৩৩৬.৩৮-৪৬) বর্ণিত হয়েছে-“পুরুষোত্তম ভগবান ধর্মবিষয়ক লক্ষ শ্লোক রচনা করেছিলেন, যার দ্বারা সমগ্র লোকসমাজের পালনীয় ধর্মের প্রবর্তন হয়েছিলো (লোকতন্ত্রস্য কৃৎস্নস্য যস্মাদ্ ধর্মঃ প্রবর্ততে)। স্বায়ংভুব মনু নিজে ঐ ধর্মগুলি প্রচার করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে উশনাঃ ও বৃহস্পতি মনু-স্বায়ংভুবের গ্রন্থ আশ্রয় করে নিজ নিজ শাস্ত্র রচনা করেছিলেন।–“স্বায়ংভুবেষু ধর্মেষু শাস্ত্রে চৌশনসে কৃতে। বৃহস্পতিমতে চৈব লোকেষু প্রতিচারিতে।।”
মহাভারতের শান্তি পর্বে রয়েছে,
“প্রজেনং স্বেষু দারেষু মার্দবং হ্রীরচাপলম।
এবং ধর্মং প্রধানেষ্টং মনু স্বায়ম্ভুবোহব্রবিং।।“ (২১/১২)
অর্থাৎ, স্বায়ম্ভুব মনু বলেছেন- নিজ স্ত্রীতে সন্তান উৎপাদন, ম্রিদুতা, লজ্জ্বা ও অচপলতা প্রভৃতি গুণগুলি অবলম্বন করাই হল শ্রেষ্ঠ ও অভিষ্ট ধর্ম।
রাজধর্ম বা রাজনীতিশাস্ত্রের রচয়িতা হিসাবে প্রাচেতস মনুর পরিচয়ও শান্তি পর্বে আছে-
“প্রাচেতসেন মনুনা শ্লৌকৌ চেমৌ উদাহুতৌ।
রাজধর্মেষু রাজেন্দ্র তাবিহৈকমনাঃ শৃণু ।।“ (৫৭/৪৩)
অর্থাৎ, মহাভারতের বনপরবে (৩৫/২১) মনুর দ্বারা মনুর দ্বারা রাজধর্ম বর্ণিত হওয়ার কথা এবং মনুর সৃষ্ট অর্থবিদ্যার প্রসঙ্গ দ্রোণপর্বে (৭/১) দেখা যায়।
৫/ গীতায় কৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন-
“ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবান্ অহমব্যয়ম্।বিবস্বান্ মনবে প্রাহ মনুরিক্ষাকবেহব্রবীৎ।।” (৪.১)
অর্থাৎ আমি ঐ যোগ পুরাকালে বিবস্বানকে বলেছিলেন এবং বিবস্বান নিজপুত্র বৈবস্বত মনুকে বলেছিলাম । পরে বৈবস্বত মনু ঐ যোগ ইক্ষাকুকে বলেছিল।
৬/ তাছাড়াও, ৮০০ থেকে ৮২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আবির্ভূত টীকাকার বিশ্বরূপ তাঁর যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতার টীকায় মনুসংহিতা থেকে দুশটিরও বেশি শ্লোকের পূর্ণাঙ্গ বা আংশিক উদ্ধৃতি দিয়েছেন বলে P.V. Kane দেখিয়েছেন।
সপ্তম শতকে আবির্ভূত বিখ্যাত অদ্বৈতবাদী বা মায়াবাদের জনক শঙ্করাচার্য তাঁর বেদান্তসূত্রভাষ্যে প্রায়ই মনুসংহিতা থেকে শ্লোক উদ্ধৃতি দিয়েছেন (উল্লেখ্য, বর্তমানকালের প্রচলিত হিন্দু দর্শন শঙ্কারাচার্যের এই মায়াবাদের উপরই আশ্রিত বলা যায়)।
২০০ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক নাটকের নবম অঙ্কে মনুর একটি অনুশাসনের উল্লেখ রয়েছে এভাবে-
“অয়ং হি পাতকী বিপ্রো ন বধ্যো মনুরব্রবীৎ। রাষ্ট্রাদস্মাত্তু নির্বাস্যো বিভবৈরক্ষতৈঃ সহ।।” অর্থাৎ, মনুর মতানুসারে পাপাচারী ব্রাহ্মণ বধ্য হবেন না, বরং এঁকে এঁর সমস্ত ধন-সম্পদের সাথে রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত করাই বিধি।
মহাকবি কালিদাস তার রঘুবংশের প্রথম সর্গে দিলিপের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন- এই রাজার শাসন প্রভাবে মনুর সময় থেকে প্রচলিত চিরাচরিত আচারপদ্ধতি থেকে তার প্রজারা বিচলিত হননি।
“রেখামাত্রমপি ক্ষুণ্ণাদা মনো বর্ত্মনঃ পরম।
ন ব্যতিয়ুঃ প্রজাস্তস্য নিয়ন্তু র্নেমিবৃত্তয়ঃ” (রঘুবংশ ১/১৭)
আবার চতুর্দশ সর্গে (৬৭ শ্লোক) কালিদাস বলছেন – রাজা যাতে বর্ণ ও আশ্রম সুরক্ষিত করতে
পারেন, তার জন্য মনু কিছু ধর্ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।
“নৃপস্য বর্ণাশ্রমপালনং যৎস এব ধর্মো মনুনা প্রণীতঃ।”
আবার কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও কয়েকবার মনুর উল্লেখ পাওয়া যায়।
আরেক স্মৃতিশাস্ত্রকার বৃহষ্পতির আবির্ভাবকাল ৫০০ খ্রিস্টাব্দের আগে। তিনিও প্রয়োজনবোধে বহুস্থানে মনুবচন উদ্ধৃত করেছেন। আবার অপরার্ক, কুল্লুক ভট্ট প্রভৃতি ভাষ্যকারগণও নিজ নিজ মন্তব্যের সমর্থনে বৃহষ্পতির ঐ উদ্ধৃতিগুলো উল্লেখ করেছেন।
যেমন, কুল্লুক ভট্ট মনুসংহিতার প্রথম শ্লোকের টীকায় মনুবচনের প্রশংসাসূচক বৃহষ্পতির দুটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে-“বেদার্থোপনিবন্ধৃত্বাৎ প্রাধান্যং তু মনুস্মৃতৌ। মন্বর্থবিপরীতা যা স্মৃতিঃ সা ন প্রশস্যতে।।” বেদের অর্থ ঠিক ঠিক ভাবে উপস্থাপিত করার জন্যই মনুস্মৃতির প্রাধান্য। যে স্মৃতি মনুবচনের বিরুদ্ধ তা নিন্দনীয়। আবার-
“তাবচ্ছাস্ত্রাণি শোভন্তে তর্কব্যাকরণানি চ। ধর্মার্থমোক্ষোপদেষ্টা মনুর্যাবন্ন দৃশ্যতে।।” তর্ক, ব্যাকরণ প্রভৃতি শাস্ত্র ততক্ষণ পর্যন্তই শোভা পায়, যতক্ষণ মনুস্মৃতি আমাদের দৃষ্টির অগোচরে থাকে। মনু হলেন ধর্ম, অর্থ ও মোক্ষের উপদেষ্টা। বোঝা যাচ্ছে, মনুবচনই বেদবাক্য হিসেবে শিরোধার্য্য হয়ে আছে।
৭/ পুরাণে পৃথিবীকে সপ্তদ্বীপা কল্পনা করে সেই সেই দ্বীপে সাতটি জাতির পর্যায়ক্রমে বসতি স্থাপনের উল্লেখ দেখা যায়। এই সাতটি ছিল মূল জাতি। প্রত্যেক মূল জাতির আদি পিতা মনু; ফলে মোট সাতজন মনুর অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এঁরা হলেন- স্বায়ংভুব, স্বারোচিষ, ঔত্তমি, তামস, রৈবত, চাক্ষুষ ও বৈবস্বত। এঁদের মধ্যে বৈবস্বত মনুকে আর্যজাতির আদি পিতারূপে কল্পনা করা হয়েছে। মনুসংহিতায় এই মনুর কথাই বলা হয়েছে ১/৬১-৬৩ শ্লোকে।
৮/বিভিন্ন শিলালেখ থেকে মনুর সম্বন্ধে জানা যায়।
৫ম ও ৬ষ্ঠ শতকে প্রচারিত কিছু অভিলেখে স্মৃতি শাস্ত্র রচয়িতা মনুর সশ্রদ্ধ উল্লেখ এবং তার দ্বারা অভিহিত বিধানের উল্লেখ আছে।
৫৩৫ ও ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দে বলভী থেকে প্রচারিত রাজা শ্রীধর সেনের অভিলেখে রাজাকে মনু ও অন্যান্যদের প্রণীত বিধি বিধান অনুসরণকারী বলে বর্ণনা করা হয়েছে- ‘মন্বাদি-প্রণীতবিধিবিধান-ধর্মা’
৮ম শতক ও তার পরবর্তী বহু তাম্রলিপিতে ‘উক্তঞ্চ মানবে ধর্মে’, ‘তত্র্য মনুগীতা ধর্মা শ্লোকা ভবন্তি’ প্রভৃতি সূচনা দিয়ে শ্লোক উদ্ধৃত করা হয়েছে।
৯/ অবশ্য মনুসংহিতা থেকেও মনু সম্বন্ধে জানা যায়।
মনুসংহিতা মতে, বিরাট পুরুষ বহুকাল তপস্যা করে মনুকে সৃষ্টি করেছিলেন। মনুকে সমুদয় জগতের দ্বিতীয় স্রষ্টা বলা হয়েছে। ১/৩৩
মনু তপস্যার মাধ্যমে দশজন প্রজা সৃষ্টি করেছিলেন। তারা হল- মরীচি, অত্রি, অঙ্গীরা, পুলহ, পুলস্ত্য, ক্রতু, প্রচেতা, বশিষ্ট, ভৃগু ও নারদ। ১/৩৪-৩৫
মরীচি প্রভৃতি দশ প্রজাপতি আরও সাতজন মনুকে সৃষ্টি করেছিলেন। ১/৩৬ তাদের নাম হল স্বরোচিষ, ঔত্তমি, তামস, রৈবত, মহাতেজা, চাক্ষুস ও বৈবস্বত। ১/৬১-৬২ অসীম ক্ষমতা সম্পন্ন এই সাতজন মনু নিজ নিজ অধিকার বলে এই চরাচর বিশ্বসংসার সৃষ্টি করে প্রতিপালন করেন। ১/৬৩
মনুসংহিতা প্রসঙ্গে মনুসংহিতায় বর্ণিত আছে,
মনুসংহিতায় বলা আছে, হিরণ্যগর্ভ ব্রহ্মা সৃষ্টির প্রথমে এই শাস্ত্র (মনুসংহিতা) প্রস্তুত করে যথাবিধি অধ্যয়ণ করিয়েছিলেন এবং মনু মরীচি প্রভৃতি মুনিগণকে পাঠ করিয়েছিলেন। ১/৫৮
মহর্ষি ভৃগু মনুর কাছে মনুসংহিতা অধ্যয়ন করেছিলেন এবং তিনিই মনুসংহিতা আদ্যোপান্ত বর্ণনা করেন। ১/৫৯
[লেখাটি সম্পূর্ণ করতে বিশেষভাবে ডাঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর ‘মনুসংহিতা প্রাককথন’ লেখাটির সাহায্য নিয়েছেন লেখক অজিত কেশকম্বলী ।]
RSS একটি তীব্র নারী বিদ্বেষী সংগঠন
- সৌতিক দাস
'আরএসএস'-এর প্রতিষ্ঠা ১৯২৫ সালে৷ প্রতিষ্ঠাতা ডঃ হেডগেওয়ারের পরে এম এস গোলওয়ালকর 'আরএসএস'-এর পরিচালক হন৷ গোলওয়ালকর ১৯৪০ সালে এই দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত টানা ৩৩ বছর 'আরএসএস'-এর পরিচালক এর দায়িত্ব সামলেছিলেন।
ফ্ল্যাশব্যাক ১৯৬০, ডিসেম্বর ১৭; গুজরাট ইউনিভার্সিটিতে স্টুডেন্ট-দের উদ্দেশে লেকচার দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পেলেন 'আরএসএস'-এর দ্বিতীয় সঙ্ঘচালক এম এস গোলওয়ালকর। সেখানে তিনি বলেন- "আজ ক্রস-ব্রিডিংয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেবল প্রাণীদের উপর করা হয়। কিন্তু মানুষের উপর এ জাতীয় পরীক্ষা করার সাহস আজকের তথাকথিত আধুনিক বিজ্ঞানীও দেখাননি। ...যে কোনও শ্রেণির বিবাহিত মহিলার প্রথম সন্তান অবশ্যই নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ দ্বারা জন্মগ্রহণ করা উচিত এবং তারপরে তিনি তার স্বামী দ্বারা সন্তানের জন্ম দিতে পারেন।"
পরবর্তীকালে 'আরএসএস'-এর মুখপত্র 'অর্গানাইজার' পত্রিকাতে ১৯৬১ সালের ২ জানুয়ারী ৫ নম্বর পৃষ্ঠাতে এই খবরটি ছাপা হয়েছিল।
অর্থাৎ ওঁর ওই বক্তব্যের সারমর্ম করলে এই দাঁড়ায় যে, আপনি যদি মহিলা হন আর কোনও সন্তানের মা হতে চান তবে আপনার স্বামীর বদলে নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের কোনও পুরুষের সাথে আপনাকে সেক্স করতে হবে যতদিন পর্যন্ত না আপনি প্রেগন্যান্ট হচ্ছেন। তারপর সেই পুরুষের ঔরসজাত সন্তান আপনার গর্ভে আসার পর দ্বিতীয় সন্তান আপনি আপনার স্বামীর সাথে সেক্স করে নিতে পারেন।
ফ্ল্যাশব্যাক ২০১৩, জানুয়ারি ৬ ; 'আরএসএস'-এর প্রধান শ্রী মোহন ভাগবত ইন্দোরের একটি জনসভা থেকে বলে উঠলেন- "বিবাহ হল চুক্তি। ছেলেরা বিবাহ করে সুখ পাওয়ার জন্যে, আর মেয়েরা বিয়ে করে ছেলেদের সুখ দেওয়ার বিনিময়ে নিজেদের পেট চালানোর জন্য। এই চুক্তি মেয়েরা যদি পূরণ করতে না পারে তাহলে পুরুষদের ওদের ছেড়ে দেওয়া উচিত।"
'আরএসএস'-এর দ্বিতীয় সঙ্ঘ-চালক গোলওয়ালকার তাঁর ‘বাঞ্চ অফ থটস’ বইয়ে ২৩৮ পৃষ্ঠায় গণপরিষদকে তুলোধোনা করে ভারতীয় সংবিধান সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছিলেন, জাতীয় লক্ষ্য, জীবন দর্শনের কোনও পথনির্দেশই সংবিধানে নেই, কোনও নিজস্বতাও নেই, কারণ গণ পরিষদের পণ্ডিতরা 'মনুস্মৃতি'র মত প্রাচীন ভারতের নৈতিক ও কার্যকরী আইনকে সংবিধানে জায়গা দেওয়ার প্রয়োজন বোধই করেননি।
বাবাসাহেব আম্বেদকর রচিত ভারতীয় সংবিধানের বদলে 'আরএসএস' সেই 'মনুস্মৃতি'কে ভারতের সংবিধান হিসেবে চেয়েছিলো যে, 'মনুস্মৃতি'র প্রতিটি পদে পদে নারী জাতির প্রতি চূড়ান্ত অসম্মানের, নারী বিদ্বেষের ইতিহাস লেখা আছে।
১৯২৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাবাসাহেব ড. ভীমরাও আম্বেদকরের নেতৃত্বে 'মনুস্মৃতি' পুড়িয়ে দিয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেখানোর ঘটনা আরও বেশি বেশি করে প্রমাণ করে, এই বইটির ছত্রে ছত্রে আছে শুধুই বিদ্বেষের সুর।
'মনুস্মৃতি'তে মোট দু’হাজার সাতশো শ্লোক ও ১২ টি অধ্যায় আছে। এই মনুশাস্ত্রে কোথাও নারীকে শূদ্রের চেয়ে বেশি মর্যাদা দেয়া হয়েছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। নারীকে স্বভাবজাত দাসী বানিয়েই রাখা হয়েছে।
মনুশাস্ত্রে নারী হচ্ছে, পুরুষের ইচ্ছাধীন এক যন্ত্র যাতে পুরুষপ্রভু তার বীর্যরূপ বীজ বপন করে পুত্ররূপ শস্য হিসেবে যোগ্য উত্তরাধিকারী উৎপাদনের মাধ্যমে ধর্মরূপ পুরুষতন্ত্রের বহমান ধারাটিকে সচল রাখতে পারবে। এখানে নারী কেবলই এক পুরুষোপভোগ্য জৈবসত্তা। নারীর মনস্তত্ত্ব বা কোনওরূপ মানসিক সত্তাকে মনুশান্ত্রে স্বীকারই করা হয়নি। নারীর দেহসত্তাটিরই প্রাধান্য এখানে, যার মালিকানাও নারীর নিজের নয় অবশ্যই। এর মালিকানা শুধুই আধিপত্যকামী পুরুষ প্রভুর। পুরুষতন্ত্র তার ইচ্ছানুরূপ শারীরিক-মানসিক ভোগ-লিপ্সা চরিতার্থ করতে পারবে।
'মনুস্মৃতি'র ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে থাকা এই নারী বিদ্বেষের কথার সাথে গোলওয়ালকর, মোহন ভাগবতদের সুর মিলে যাচ্ছে তো!
সেই কারণেই সেদিন 'আরএসএস', বাবাসাহেব আম্বেদকর রচিত ভারতীয় সংবিধানের বদলে এই 'মনুস্মৃতি'কে ভারতের সংবিধান হিসেবে চেয়েছিল।
আমি আমার সীমিত ক্ষমতা দিয়ে সারাজীবন এদের বিরোধীতা করে যাব। আমার আশেপাশের সাধারণ মানুষকে এভাবেই বার বার বুঝিয়ে যাব যে, 'আরএসএস' শুধু একটি দেশদ্রোহীদের সংগঠন না তার সাথে একটি তীব্র নারী বিদ্বেষী সংগঠনও।
সবাইকে ভালোবাসা যায় না, কাউকে কাউকে ঘৃণা করতেও জানতে হয়। আমি আমার সীমিত ক্ষমতা দিয়ে এদেরকে ঘৃণা করতাম, ঘৃণা করি আর আজীবন করে যাব।
কথা দিলাম আপনিও যেদিন 'আরএসএসে'র পুরো ইতিহাস পড়ে ফেলবেন, জেনে ফেলবেন, বিশ্বাস করুন ঠিক সেদিন আপনিও ঘৃণাতে বমি করে ফেলবেন।
ওয়াক থুঃ!
লোক ঠকানোর ধান্দাবাজি: বাটি চালানোর মূল রহস্য!
-এস এ খান
বাটি চালানোতেই যদি কাজ হতো তবে পুলিশ, গোয়েন্দা, সি বি আই, সি আই ডি, “ডগ স্কোয়াড” না রেখে “বাটি চালানো স্কোয়াড” রাখা হতো! এর কোনও বৈজ্ঞানিক কৌশল নেই’ই এমনকি এমন ঘটার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও নেই। যেটা আছে সেটা হল ভাঁওতাবাজি এবং “সফল বাটি চালানোর” কেস স্টাডিতে পাওয়া যায় “অভ্যন্তরীণ রাজনীতি” আর অপরাধীকে আড়াল করে কোনও "সজ্জন ব্যক্তিকে ফাঁসানোর" মারপ্যাঁচ ।
প্রথমেই তথাকথিত “বাটি চালনো” পদ্ধতিটা জেনে নেওয়া যাক, যেটার কথা বলা হয়ে থাকে :
১. তান্ত্রিক সাধু লোক তার তন্ত্র-মন্ত্র পড়ে বা আগে থেকে “পড়ে রাখা” বাটি রাখবে মাটিতে।
২. তথাকথিত “তুলা রাশির জাতক”কে সেটা হাত দিয়ে ধরতে হবে, কেউ কেউ বাটিতে হাত রাখতে বলে, কখনও হাতে লাঠি নিয়ে লাঠির মুক্তপ্রান্ত বাটির মধ্যে রাখতে বলা হয়।
৩. বাটি চলা শুরু করে ও কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে চলে যায় ধরে রাখা ব্যক্তিটাকে নিয়ে।
প্রথমেই পরিষ্কার মনে রাখা প্রয়োজন, পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম লঙ্ঘন করে বাটির নিজে নিজে চলা সম্ভব নয়।
কোনও বস্তুকে স্থির অবস্থা থেকে নাড়াতে চাইলে আপনাকে এর ওপর বল প্রয়োগ করতে হবে। বাটির ওপর যান্ত্রিক শক্তি প্রয়োগ করতে পারেন; বাটি যদি লৌহজাতীয় ধাতুর তৈরি হয় সেক্ষেত্রে চৌম্বক শক্তি প্রয়োগ করতে পারেন; এমনকি রাসায়নিক বিক্রিয়া ব্যবহার করেও শক্তি উৎপন্ন করে কাজে লাগানো যায়। ধান্দাবাজদের বাটি চালানোর ক্ষেত্রে আসি। ইশারায় যদি কোনও বস্তুকে নাড়ানো হয়- তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ইশারা থেকে উৎপন্ন শক্তি বাটিকে নাড়াচ্ছে। এই ব্যাপারটি যদি সত্যি ঘটে থাকে, তাহলে তা এসব ছোটখাট কাজে ব্যবহার না করে বড় কাজে ব্যবহার করা যায়।
যেমন, যেসব ওঝা /তান্ত্রিক /বাবা ইশারায় বাটি নাড়ান তারা একত্র হয়ে একটি পরিবহন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। এই সংস্থা কোনও জ্বালানি বা শক্তি প্রয়োগ ছাড়াই বস্তু সরানোর কাজ করে দেবে। এতে পৃথিবীর জ্বালানি সমস্যা মিটে যাবে। নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসও খুঁজতে হবে না। মহাকাশে যান পাঠাতে আর জ্বালানি লাগবে না, তাদের ইশারার মিলিত শক্তি সেগুলোকে অরবিটে পাঠিয়ে দেবে। বাস, ট্রাক, প্লেনে এইসব লোককে নিয়োগ করা যায়। তাদের ইশারা থেকে প্রাপ্ত শক্তি ব্যবহার করে যানবাহন চলবে। পৃথিবীর শক্তি বিষয়ক যাবতীয় সমস্যা মিটে যাবে। পৃথিবী হয়ে উঠবে শক্তি আত্মনির্ভর!
যাই হোক, আসল কথা বলি- বাটি চালান দিয়ে কখনোই ইশারার মাধ্যমে বাটি নাড়ানো সম্ভব না। তা সম্ভব হলে পদার্থবিদ্যা সূত্রগুলো নতুন করে লিখতে হবে, আর এরা পাবেন নোবেল পুরষ্কার। এই জাতীয় ঘটনাগুলোয় সবসময়ই কোনও না কোনও কৌশল ব্যবহার করা হয়। ঠিক যেমন যাদুকরেরা তাদের কৌশল ব্যবহার করে আমাদের চোখে ধুলো দেয়। আর ওঝা / তান্ত্রিক/ হুজুর / বাবাদের হাত থেকে যদি নিজের আত্মীয়পরিজনকে বাঁচাতে চান তাহলে তাদেরকে হয়- পদার্থবিজ্ঞান শেখাতে পারেন, নয়তো স্রেফ বলতে পারেন যে, ধর্মে যাদুবিদ্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমি নিশ্চিত, এটা কাজ করবে!
এখন আসি ঘটনা বিশ্লেষণে। সে ক্ষেত্রে জানিয়ে রাখি দুটো বিষয়:
১. এধরনের ঘটনায় বহুবার বাটি না নড়ার এবং বহুবার কাঙ্ক্ষিত স্থানে না পৌঁছাবার ঘটনা ঘটে এবং প্রায়শই যাদের পরিবারে বাটি চালান পদ্ধতি প্রয়োগের ঘটনা ঘটে থাকে তাদের ফলাফল না পাবার ঘটনা জানা থাকবার কথা। (তারপরেও আস্থা কীভাবে থাকে সেটা বোধগম্য নয়)
২. তান্ত্রিক/বাবা/ওঝা ব্যক্তি পইপই করে বলতে থাকে “আমার উপরে বিশ্বাস রাখতে হবে সবার, আমার তন্ত্রের উপরে বিশ্বাস রাখতে হবে সবার, নয়ত চালান কাজ করবে না।” এটা হল সেইফ জোনে যাওয়ার সেরা উপায়। কাজ না করলেই বলে ফেলা যায়। আপনাদের মধ্যে কেউ হয়ত আমাকে, আমার তন্ত্রকে বিশ্বাস করেননি। তাই হয়নি।
এবার দেখা যাক কী ঘটে?
যখন তান্ত্রিক নিজেই “তুলা রাশির জাতক” সাপ্লায়ার তখন বলাই বাহুল্য সাপ্লায়ার নিজেই বাটি চালনার চালিকা শক্তির উৎস এবং নিজেই ঠেলে নিয়ে যায়। সম্ভাব্য কোনও স্থানে। মিলে গেলে কাকতালীয় বাহবা, আর না মিললে উপরে ২ নম্বর পয়েন্ট হড়বড় করে বলে দেওয়া।
যখন পরিবারের কেউ বা বাইরের কোনও ভলান্টিয়ারকে বাটিতে হাত রাখতে বলা হত তখন দুটো ঘটনা ঘটতে পারে।
১. যদি ভলান্টিয়ার নিজে বেশ গভীরভাবে মনে করে “বাটি চালান” কাজ করেই তবে সে হাত রাখার পরে অজান্তেই তার মনে হয় বাটি নড়ছে। এতে সে নিজেও ওইদিকে হাত নাড়ায় ফলে বাটি এগোতে থাকে। আর একবারে এগিয়ে গেলে সেটা আরও পেয়ে বসে ও কোনও একটা জায়গায় গিয়ে থামে। ভলান্টিয়ার বুঝতেও পারে না সে নিজেই নিয়ে যাচ্ছে বাটি। তার মনে হয় বাটিই তাকে নিয়ে যাচ্ছে। এটা সম্পূর্ণই মানসিকে চাপ ও সাব-কনশাস মাইন্ডের খেলা।
২. শুরুতে যে রাজনীতির কথা বলেছিলাম এখন সেটাই বলছি। এটা আমার নিজের ছোট সময়ের একটা ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে সংগৃহীত। ওদিনই বুঝে গিয়েছিলাম, বাটি চালান “বড়দের একটা পাতানো খেলা” মাত্র।
সচরাচর যদি খুব দামী কিছু খোয়া যায় যেমন, স্বর্ণালংকার বা বড় অংকের টাকা বা ধরুন, এখন দামী মোবাইল এবং ধারণা করা হয় চুরি হয়ে বাইরে যায়নি তাহলে সেটা খুঁজতে “বাটি চালান” পদ্ধতি এখনও অনেকে অবলম্বন করে।
এক্ষেত্রে যদি অপরাধী সেখানে থেকেই থাকে এবং পরিবারে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের কেউ হয় এবং সেও মনেপ্রাণে ধরে নেয় “বাটি চালান দিলে তো আমি ধরা পড়েছি”।
তাহলে সম্মান বাঁচাতে যে ঘটনাটা ঘটে –
সে বাঁচতে স্বীকার করার সিদ্ধান্ত নেয়, সবার সামনে ধরা পড়লে মান-সম্মান যাবে এই ভয়ে। তখন সে এমন কাউকে বলে যে তাকে মারবে না। তখন সে তেমনই একজন মুরুব্বির/মোড়ল/পাড়ার দাদার হাতে পায়ে ধরে নাকের জল চোখের জল এক করে মাফ চায় এবং জিনিস ফেরত দেয়।
মুরুব্বি/মোড়ল তাকে ও পরিবারের সম্মান বাঁচাতে বাড়ির কোনও অন্ধকার ঘুপচিতে জিনিসটা লুকিয়ে রাখে। ঘরের “তুলা রাশির জাতক”কে সাইডে নিয়ে সেট আপ দেয়, পুরা ঘটনাটা বুঝিয়ে দেয় কীভাবে কী করতে হবে মানরক্ষার্থে। যথাসময়ে সেই সেট আপ হওয়া তুলা রাশির জাতক বাটি সেই মুরুব্বির/মোড়লের পূর্ব লুকানো স্থানে নিয়ে যায়। জিনিস পাওয়া যায়, অপরাধী উলালা উলালা আর এইদিকে তান্ত্রিক রকস।
এটাই হচ্ছে বেশিরভাগ সফল বাটি চালানের “অভ্যন্তরীণ রাজনীতি”।
এছাড়াও কাউকে চাপ দিয়ে টাকা আদায় করতে বা অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে তার সম্পত্তি দখল নিতেও অনেকে তান্ত্রিক / ওঝার সঙ্গে জোট বাঁধে। আখের গুছোয়।